প্রায় দেড় বছর ধরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল নিম্নমুখী। আর গত ৫৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি ছিল এই বছরের এপ্রিল মাসে। এই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল মাত্র ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। বর্তমানে সামান্য গতি পেয়েছে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত মে মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। তবে, ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ বিতরণে সামান্য গতি দেখা গেলেও চাহিদা অনুযায়ী বিতরণ করা যাচ্ছে না। তারা বলছেন, একদিকে প্রয়োজনীয় আমানত না আসায় ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের ঋণের চাহিদা মেটাতে পারছে না, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) নতুন সীমায় নামিয়ে আনার একটি চাপও রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাস শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯১৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মে মাস শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৯২ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। এই হিসাবে গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৮ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়েও আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। এ বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে মাত্র চার হাজার ১৭ কোটি টাকা। অথচ একই সময়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। যদিও বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে তার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা ঋণ দিতে পারে। আর ইসলামি ধারার ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৯ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। তবে, বেশ কিছু ব্যাংক ১০০ টাকার বিপরীতে ১০০ টাকাই বিতরণ করেছে। কোনও কোনও ব্যাংক ১০০ টাকার বিপরীতে ১০৫ টাকাও ঋণ বিতরণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়তে হবে। তার আগে ব্যাংকগুলোকে চাহিদা অনুযায়ী আমানত পেতে হবে। তা না হলে ব্যাংক ঋণ দিতে পারবে না। আর ঋণ বিতরণ না হলে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগও হবে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘দেশে কর্মসংস্থান ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য অংশ হয় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে।’
প্রসঙ্গত, গত ৩০ জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত মে মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর জুনে প্রবৃদ্ধি সামান্য বেড়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪ শতাংশ দূরে রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২৩ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। আগের বছরের মার্চে যা ছিল ৯ লাখ ২৫ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অথচ বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে ব্যাংকে তারল্য কমেছে ১৬ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। এই বছরের মার্চে তরল সম্পদ (লিকুইড অ্যাসেট) দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে যা ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং পদ্ধতি অনুসারে, ঋণের টাকা নগদ হিসেবে গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া হয় না। অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়। অর্থাৎ যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়, ওই পরিমাণ অর্থ আমানত হিসেবে যোগ হয়। আবার ব্যাংকগুলো নতুন নতুন গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ঋণের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি বেশি থাকার কথা। কিন্তু এখন ঘটছে উল্টো।
জানা গেছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকের হাতে বিনিয়োগ করার মতো টাকা নেই। কোনও কোনও ব্যাংক ১২ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে। কোনও কোনও ব্যাংক পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ করার আশ্বাসে আমানত সংগ্রহ করছে। এরপরও আশানুরূপ আমানত বাড়াতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়া ছাড়াও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ও ব্যাংকের সুদের পার্থক্য থাকায় ব্যাংক আমানত পাচ্ছে না। ঋণখেলাপিদের শাস্তি হলে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে। তখন এমনিতেই আমানত বাড়বে।’ ঋণ বাড়ানোও সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন।