সীমান্ত দিয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র, মাদকদ্রব্য ও চোরাচালানকৃত পণ্য কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছে। এমনকি মুক্তিপণ আদায়ের জন্য এখন কৌশল বদলে কুরিয়ারের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করছে অপরাধীরা। এসব রুখতে কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে মাদক ও অস্ত্র শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন এবং গ্রাহকদের তথ্য সংরক্ষণ (কেওয়াইসি) বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। পাশাপাশি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের সীমাও বেঁধে দেওয়া হবে। আর কুরিয়ার সার্ভিসের সার্বিক কর্মকাণ্ড ডাক বিভাগের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় মনিটর করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে ‘মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঘুষ আদান-প্রদান এবং মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি নিরসনে’ একটি আন্ত সংস্থা বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে যে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র, চোরাচালানকৃত পণ্য ও মাদক বহন করা হয়। এগুলোকে প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে সীমান্ত থেকেও এসব অস্ত্র আসে, যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মাদকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।’
মুক্তিপণ আদায়ে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করা হচ্ছে কি না—জানতে চাইলে রাজি হাসান বলেন, “আগে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা নেওয়া হতো। আমরা সেগুলো চিহ্নিত করেছি। কিন্তু কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হলে, তা চিহ্নিত করার কোনো উপায় থাকে না। এ জন্য কুরিয়ার সার্ভিসের একটি ‘রেগুলেটরি বডি বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা’ থাকতে হবে। এটি খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।”
একই বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘এ ব্যাপারে একটি বৈঠক হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ এর বেশি আর কোনো কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
সূত্র মতে, বিএফআইইউ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে খবর রয়েছে, সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে আসা অস্ত্র, মাদকদ্রব্যসহ অন্যান্য পণ্য বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস ও পরিবহন সংস্থার মাধ্যমে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছে। কুরিয়ার সার্ভিস একক কোনো সংস্থার নজরদারিতে না থাকার কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে বলে বৈঠকে বিশদ আলোচনা হয়। এতে বলা হয়, কুরিয়ার সার্ভিসগুলো ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করলেও যুগোপযোগী কোনো আইন নেই। শত বছরের পুরনো পোস্টাল আইন (১৮৯৮) দিয়েই চলছে কুরিয়ার সার্ভিস। একক নিয়ন্ত্রক সংস্থাও নেই। ফলে অনেক বিষয়ই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে অস্ত্র ও পণ্য স্ক্যানার নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঠিক নজরদারির অভাব রয়েছে। ফলে এর সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। এর সঙ্গে কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু অসাধু কর্মচারীও জড়িত রয়েছে। এসব কর্মচারীর যোগসাজশে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যও কুরিয়ারে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছে। প্রায়ই এসব পণ্য ধরা পড়লেও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ীদের এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। তবে শুধু দেশি নয়, দেশে কাজ করা বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও দেশ-বিদেশে পণ্য পাচারের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এদেরও নজরদারির আওতায় আনার ব্যাপারে বৈঠকে বিশদ আলোচনা হয়। পাশাপাশি বলা হয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে স্ক্যানার মেশিন থাকতে হবে। গ্রাহকদের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ‘কেওয়াইসি বা নিজের গ্রাহককে জানো’ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
বৈঠকে কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধিরা স্ক্যানার না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে। ব্যবসায়ীরা বলেছে, স্ক্যানিং মেশিনের দাম বেশি। তাই বাংলাদেশে কোনো কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান এ মেশিন ব্যবহার করে না। সবাই ফিজিক্যালিই চেক করে। তবে বুকিংদাতার জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স বা পাসপোর্টের ফটোকপি ছাড়া আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসে পার্সেল বুকিং নেওয়া হয় না।
বৈঠকে বলা হয়, আগে অপরাধীরা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করত। এ কারণে কক্সবাজার, বান্দরবানের মতো এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং নিরাপদ রাখতে সীমা নির্ধারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে অপরাধীরা এখন কৌশল বদলে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করছে। শুধু অপরাধী নয়, বিভিন্ন কাজের জন্য ঘুষ লেনদেনেও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো কুরিয়ার সার্ভিসে লেনদেনের ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। পাশাপাশি অর্থ প্রেরণকারী ও গ্রহণকারীর তথ্য সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।