ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম বন্ধের পাশাপাশি এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি তোলা হচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এক অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপরও ব্যাংকিং কমিশন গঠন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হচ্ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হলে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। তার মতে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া কমিশন প্রতিষ্ঠা করেও কোনও লাভ হবে না।
প্রসঙ্গত, খেলাপি ঋণের লাগাম টানাসহ ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্য গত কয়েক বছর ধরে আলাদা কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করে আসছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। এর বাইরেও ব্যাংকিং কমিশন গঠনের বিষয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে।
২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। তবে তার এই ঘোষণার আড়াই বছর পার হলেও কমিশন গঠন সম্ভব হয়নি।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক কমিশন গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবারের বাজেট বক্তৃতায়। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কোনও ধরনের সংস্কার আমরা লক্ষ করিনি। ব্যাংক থেকে কোনও ঋণগ্রহীতা ঋণ নিয়ে তা শোধে ব্যর্থ হলে তার জন্য কোনও ধরনের এক্সিটের ব্যবস্থা ছিল না। আমরা এবার এই কার্যক্রমটি আইনি প্রক্রিয়া সুরাহার লক্ষ্যে একটি কার্যকর ইনসলভেন্সি আইন ও ব্যাংক ক্রাপ্টসি আইনের হাত ধরে ঋণগ্রহীতাদের এক্সিটের ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।’
তবে আলাদা করে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দরকার নেই বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সমস্যা কী, তা সবারই জানা। আবার সমাধান কীভাবে হবে, তাও সবার জানা।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং কমিশনের কাজ হলো সুপারিশ করা। এরই মধ্যে ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন মহল সরকারকে বেশকিছু সুপারিশ করেছে। কিন্তু কোনও সমাধান হচ্ছে না।’
মীর্জ্জা আজিজুল বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কমিশন না করেও সমাধান করা সম্ভব। আর সরকারের যদি সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে কমিশন করেও কোনও ফল আসবে না।’
অবশ্য সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সিপিডি মনে করে ব্যাংক খাতের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা দরকার। তিনি বলেন, ‘সিপিডি থেকে আমরা অনেকদিন ধরেই বলছি ব্যাংকিং কমিশনের কথা। এবারের বাজেটেও ব্যাংকিং কমিশনের ব্যাপারে ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার কথা বর্তমান ও আগের অর্থমন্ত্রীও বলেছিলেন।’
ব্যাংকিং কমিশনের কাজ কী
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ একজনকে ব্যাংকিং কমিশনের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেবে সরকার। তিনি ব্যাংকিং কমিশনের কাজের চিত্র তুলে ধরেন।
১. খেলাপি ঋণের লাগাম টানাসহ দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে এ-সংশ্লিষ্ট আইন সংস্কারের বিষয়ে কাজ করবে;
২. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা বিধান করবে;
৩. ইচ্ছাকৃত খেলাপি আর অনিচ্ছাকৃত খেলাপি আলাদা করার কাজ করবে;
৪. টাকা কীভাবে আদায় করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করবে;
৫. আইনি কাঠামোর সংস্কার করবে;
৬. খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য সমস্যার মূল চিহ্নিত করবে;
৭. ব্যাংক বোর্ডের গঠনের জন্য নীতিমালা করবে;
৮. আইন প্রয়োগে সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং আইনের পরিবর্তনে কাজ করবে এবং
৯. কমিশন ব্যাংকিং খাতের দক্ষ, যুগোপযোগী ও সুশাসনভিত্তিক পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেবে।
সিপিডির এই ফেলো বলেন, কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার একটা রূপরেখা দেবে এই কমিশন। তবে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে সরকারকে। তিনি বলেন, আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে এ ধরনের একটি উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সাধারণত, ব্যাংকিং কমিশন হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো এটাও স্থায়ী কমিশন হবে না। এটা হবে ৩ বা ৬ মাসের জন্য। কমিশন এই সময়ের মধ্যে সরকারকে একটি প্রতিবেদন দেবে। তাতে যেসব সুপারিশ করা হবে, সেসব কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তারও গাইডলাইন বা রূপরেখা থাকবে।