বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড (মিল্ক ভিটা) জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৩০ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করেছে । কিন্তু চলতি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে তার পরিমাণ এক লাখ টনের নিচে নেমে এসেছে। একই অবস্থা দেশের শীর্ষ করপোরেট প্রতিষ্ঠান আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজেরও। প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি তরল দুধের বিক্রি কমেছে প্রাণ ডেইরি ও ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেরও (আড়ং)।
জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পাস্তুরিত তরল দুধের প্রায় ৭০ শতাংশ বিপণন করে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় চার প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ ডেইরি ও আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চার প্রতিষ্ঠান মিলে প্রতিদিন গড়ে ৪ লাখ ২৫ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করেছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তা ২ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ লিটারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে এ চার প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত দুধ বিক্রি কমেছে দৈনিক ৩৯ হাজার ৫০০ লিটার বা ৩৩ শতাংশ। প্রায় একই হারে কমেছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দুধ বিক্রিও।
বিক্রি কমার কারণ হিসেবে সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়ে জনমনে সৃষ্ট আতঙ্ককে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় ডেইরি উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এবং ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজ আড়ংয়ের পরিচালক এম আনিসুর রহমান বলেন, কোনো ধরনের ভুল গবেষণা ভোক্তাদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পারে। এখনই এটি বন্ধ করা না গেলে দেশের খামারিরা বিপদে পড়বেন। আর খাতটি বিনিয়োগহীন হয়ে পড়লে মানহীন আমদানি করা গুঁড়ো দুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে দেশ
গত ২৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ কোম্পানির সাত ধরনের পাস্তুরিত দুধের নমুনায় অ্যান্টিবায়োটিক ও তিন ধরনের দুধে ডিটারজেন্টের উপস্থিতির কথা জানানো হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর থেকেই জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিগুলোর তরল দুধের বিক্রি কমে গেছে। বিক্রি কমায় খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহও কমিয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো।
সবচেয়ে বেশি পাস্তুরিত দুধ বিক্রি করে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড (মিল্ক ভিটা)। প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৩০ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের বিক্রি দৈনিক ৩৪ হাজার লিটার বা ২৬ শতাংশ কমেছে।
মিল্ক ভিটার অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক মো. মুস্তাফিজুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিক্রি কমায় আমাদের দুধের মজুদ বেড়ে গেছে। এ কারণে খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিতে হয়েছে। এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে দুধ সংগ্রহ আরো কমিয়ে দিতে হবে। এতে লোকসানে পড়বে খামারিরা।
এ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ দেশের বাজারে বিক্রির পাশাপাশি দুগ্ধজাত পণ্য রফতানিও করে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বাজারে প্রতিষ্ঠানটির দুধ বিক্রি কমেছে দৈনিক প্রায় ৩৬ হাজার লিটার বা ৪০ শতাংশের মতো। আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ আগে প্রতিদিন গড়ে ৯০ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করলেও এখন তা ৫৪ হাজার লিটারে নেমে এসেছে।
আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সহকারী মহাব্যবস্থাপক এমএম ইকবাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকের প্রতিবেদনের পর আমরা বাইরের প্রতিষ্ঠান দিয়ে আকিজের দুধের মান পরীক্ষা করেছি। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো ধরনের উপাদানের উপস্থিতি তাতে পাওয়া যায়নি। মাত্রা অনুযায়ীই পাওয়া গেছে সব উপাদান। এখন আমাদের হাতে ভালো দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য থাকার পরও বাজারে বিক্রি করতে পারছি না। সবচেয়ে বড় বিপদ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশের পণ্যের বিষয়ে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। এতে সামনের দিনে ভালো মান থাকার পরও পণ্য বিক্রি অসম্ভব হয়ে পড়বে।
প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রাণ ডেইরি দুধ বিক্রি কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। আগে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ লিটার দুধ বিক্রি করত প্রতিষ্ঠানটি। গবেষণা প্রতিবেদনটির তথ্য প্রকাশের পর তা ৬৫ হাজার লিটারে নেমে এসেছে।
একইভাবে সপ্তাহের ব্যবধানে আড়ংয়ের দুধ বিক্রি কমেছে ৩৪ হাজার ৫০০ লিটার বা ৩৩ শতাংশের মতো। আগে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৫ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করত প্রতিষ্ঠানটি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে তা ৭০ হাজার ৫০০ লিটারে নেমে এসেছে। এছাড়া মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রিও প্রায় একই হারে কমেছে।
কোম্পানিগুলোর পাস্তুরিত তরল দুধ বিক্রি কমে যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন খামারিরাও। আগের মতো দুধ বিক্রি করতে পারছেন না তারা।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান এ প্রসঙ্গে বলেন, গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক দিন পর থেকেই কোম্পানিগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিয়েছিল। চলতি সপ্তাহে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে দুধ সংগ্রহ। সারা দেশের খামারিরা উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। দুধ বিক্রি করতে না পারলে খামার বন্ধ করে দিতে হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে প্রতিদিন ২ কোটি ২০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। এর মাত্র ৭ শতাংশ কোম্পানিগুলো সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতের পর বাজারে বিক্রি করে। সবচেয়ে বেশি দুধ সংগ্রহ করে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড (মিল্ক ভিটা)। ব্র্যাকের আড়ং, প্রাণ আকিজ ছাড়াও রংপুর ডেইরি ফুড অ্যান্ড প্রডাক্ট লিমিটেড, ফার্ম ফ্রেশ, আফতাব ও আব্দুল মোনেম গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দুধ সংগ্রহ করে থাকে। খামারিদের কাছ থেকে এ দুধ সংগ্রহ করে তারা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ডেইরি শিল্প উদীয়মান শিল্প হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। দুধ একটি স্পর্শকাতর খাদ্যদ্রব্য বিধায় ভুল প্রতিবেদনের কারণে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ দেশীয় দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা নিম্নমানের গুঁড়ো দুধের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। প্রাণ, মিল্ক ভিটা ও আড়ংসহ অন্যান্য কোম্পানির যেসব দুধ বাজারে বিপণন হচ্ছে, সেগুলোর মান আমরা তদারক করছি।