খেলাপিরা ঋণ পরিশোধে টানা ১০ বছর সময় পাচ্ছেন

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৭-১৫ ১০:২২:৫১


বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়ে পুনঃতফসিল নীতিমালার যে সার্কুলার জারি করেছিল, সেটা অবশেষে কার্যকর হচ্ছে। জারি করা সার্কুলার অনুযায়ী খেলাপিরা ঋণ পরিশোধের জন্য টানা ১০ বছর সময় পাবেন।বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সার্কুলারটি পরিপালন করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে আগামী দুই মাস ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা নিতে পারবেন ঋণখেলাপিরা। তবে এই দুই মাস নতুন করে কোনও ঋণ পাবেন না তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঋণখেলাপিরা মাত্র দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবেন। পুনঃতফসিল হওয়া ঋণ পরিশোধে তারা সময় পাবেন টানা ১০ বছর। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরাও এই সুযোগ পাবেন। শুধু তাই নয়, এই ধরনের ঋণখেলাপিদের প্রথম এক বছর কোনও কিস্তিও দিতে হবে না। আর চিহ্নিত এই ঋণখেলাপিদের গুনতে হবে ৯ শতাংশেরও কম সুদ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘সরকার ঋণ খেলাপিদের পছন্দ করে। এ কারণে তাদের নানাভাবে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংক খাতে ভালো ঋণ এখন ৯ লাখ কোটি টাকার ওপরে। এই ৯ লাখ টাকা দেওয়া গ্রাহকদের সরকার সুবিধা না দিয়ে মন্দ ঋণের এক লাখ কোটি টাকার গ্রাহকদের বেশি মদদ দিচ্ছে।’

খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে  খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে। তাতে প্রকৃত ঋণ খেলাপিদের খেলাপি বলা যাবে না। আরেক সার্কুলারে ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যত খেলাপি হয়েছেন, তারা সবাই মাত্র ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে দশ বছরের জন্য নিয়মিত হতে পারবেন।’ তার মতে, ‘যারানিয়মিত  ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন, তাদের চেয়ে খেলাপিদের সুযোগ বেশি থাকায় ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ বেড়ে এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।’

এরআগে, গত ১৬ মে খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক  এই সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করলে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ওই সময় এই সার্কুলারের ওপর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন স্থিতাবস্থা জারি করেন। তবে, গত ৮ জুলাই হাইকোর্ট ডিভিশনের স্থিতাবস্থার ওপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২ মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলার অবশেষে কার্যকর হচ্ছে।

এদিকে, ১১ জুলাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো নতুন সার্কুলারে বলা হয়েছে—বিআরপিডি সার্কুলার নং-৫, ১৬ মে ২০১৯-এর ওপর হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক জারি করা স্থিতাবস্থার ওপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ৮ জুলাই ২ মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। ওই আদেশের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা নিতে হলে আগামী ১৬ আগস্টের মধ্যে খেলাপিদের আবেদন করতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ও ৯ শতাংশ সরল সুদে ১০ বছরের জন্য ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে খেলপি ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়। এতে পুনঃতফসিলের সুবিধা নিতে ৯০ দিনের মধ্যে আবেদন করার সময় নির্ধারণ করা আছে।

গত ১৬ মে জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছে, ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিতে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা শীর্ষক এই সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিক ঋণখেলাপিরা সুযোগ পাবেন বলে ঘোষণা দেওয়া আছে। ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সুবিধা পেতে আগামী ১৬ আগস্টের মধ্যে খেলাপির আবেদন করতে হবে। মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে আগামী ১০ বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবেন। প্রথম একবছর কোনও টাকা পরিশোধ করতে হবে না। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বা ব্যাংকের কস্ট ফান্ডের সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করে।

মূলত, খেলাপি ঋণের সুদ ব্যাংক আয় দেখাতে পারে না। পৃথক হিসাবে রাখতে হয়। সার্কুলারে এ বিষয়ে বলা হয়, পৃথক হিসাবে রাখা সব সুদ মাফ করে দেওয়া হবে। এ সুবিধা নেওয়ার পর নিয়মিত অর্থ পরিশোধ না করলেও তাদের খেলাপি করা যাবে না।

সার্কুলারের তথ্য অনুযায়ী, ৯টি মাসিক কিস্তির ৩টি এবং ত্রৈমাসিক ৩ কিস্তির একটি পরিশোধ না করলেও গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। তবে ৯টি মাসিক কিস্তির মধ্যে ৬টি ও ত্রৈমাসিক কিস্তির ২টি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল করা হবে।

সার্কুলারের নির্দেশনা অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে যারা ঋণখেলাপি তাদের এককালীন এক্সিট সুবিধা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের খেলাপি ঋণের হিসাব হবে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এককালীন হিসাবায়ন ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যত খেলাপি ঋণ আছে তার হিসাব করা হবে। কোনও ঋণখেলাপি যদি মনে করেন, এককালীন ঋণ পরিশোধ করে খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবেন, তাহলে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে সার্কুলারে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, এককালীন এক্সিট সুবিধা ও পুনঃতফসিল সুবিধা কার্যকরের ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহকের মামলা স্থগিত করতে হবে। পরবর্তী সময়ে গ্রাহক কোনও শর্ত ভঙ্গ করলে সুবিধা বাতিল করে মামলা পুনরায় চালু হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ৩১ ডিসেম্বর সময়ে মন্দ ঋণগ্রহীতার অনুকূলে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পুনঃতফসিল বা এক্সিট সুবিধা দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ এককালীন এক্সিট করতে হলে এই সার্কুলারের আওতায় ঋণগ্রহীতার আবেদন পাওয়ার তারিখ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেবে। তবে যেসব ক্ষেত্রে বিশেষ নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে, সেসব ক্ষেত্রে নিরীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সুবিধা পাবে যেসব খাত

ট্রেডিং খাত (গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি), জাহাজ শিল্প (শিপ ব্রেকিং ও শিপ বিল্ডিং), লৌহ ও ইস্পাত শিল্প। অন্যান্য খাতের ব্যাংক কর্তৃক বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত প্রকৃত ব্যবসায়ী, যাদের ঋণ নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূত কারণে মন্দমান শ্রেণিকৃত হয়েছে। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকের অকৃষি খাতের আমদানি-রফতানিতে সম্পৃক্ত রয়েছে শিল্পঋণও।