সাধারণ কৃষকদের জন্য ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চাল রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রাথমিকভাবে ২ লাখ টন সিদ্ধ চাল রফতানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একজন ব্যবসায়ী একবারে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টন চাল রফতানি করতে পারবেন। প্রথমবার অনুমোদন নেওয়া চালের রফতানি শেষ হলে পুনরায় ওই ব্যবসায়ী আবেদন করতে পারবেন।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআরের চেয়ারম্যান, ট্যারিফ কমিশন, ইপিবির চেয়ারম্যানসহ সংশ্নিষ্টদের চাল রফতানির এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
এই প্রথমবার বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা মোটা চাল রফতানির সুযোগ পেলেন। রফতানি নীতি অনুযায়ী চাল রফতানি নিষিদ্ধ। তবে সরকার থেকে সরকার পর্যায়ে চাল রফতানির সুযোগ আছে। এ ছাড়া ২৫ ধরনের সুগন্ধি চাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়ে রফতানি করতে পারেন ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্য, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে বেসরকারি খাতে চাল রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে প্রথমবার বাংলাদেশ থেকে চাল রফতানি হয়। ওই বছর ৪৫০ ডলার মূল্যে ৫০ হাজার টন চাল শ্রীলংকার সরকারের বরাবর রফতানি করে বাংলাদেশ সরকার।
ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার উদ্বৃত্ত উৎপাদন দেখে রফতানির সিদ্ধান্ত নিলেও তা এখন সময়োপযোগী নয়। কারণ, সম্প্রতি দেশের বড় অংশ বিশেষ করে যে অঞ্চলে বেশি ধান উৎপাদন হয়, সেই অংশ বন্যায় ডুবে গেছে। এতে যেমন আমন মৌসুমের অনেক বীজতলা নষ্ট হয়েছে, তেমনি অনেকের ঘরে রাখা ফসল নষ্ট হয়েছে। এছাড়া রফতানির ক্ষেত্রে সিদ্ধ চাল কেন তা নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেকের। কৃষক যেমন সিদ্ধ ধান বিক্রি করেন না, তেমনি বিশ্ববাজারে আতপ চালের চাহিদা বেশি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধানের উৎপাদন কম হয়েছিল। যে কারণে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই আমদানি হয়েছে বছরজুড়ে। এ বছর ধানের ব্যাপক উৎপাদনের ফলে আমদানি করা চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী খাদ্য মন্ত্রণালয়ে চাল রফতানির আবেদন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চাল রফতানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। এছাড়া খাদ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে বলেছেন ১০ থেকে ১৫ লাখ টন চাল রফতানি করা হবে। অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন ভর্তুকি দিয়ে হলেও চাল রফতানি করা হবে।
এ বিষয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মৌসুমের শুরুতে দাম কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সরকার চাল রফতানির কথা বলছিল। এখন রফতানির সুযোগ দেওয়া হলে যারা কম দামে কিনেছে তারাই রফতানি করবে। এতে কৃষকের লাভ বিশেষ হবে না। অপরদিকে একটা বন্যা চলছে, এটা দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আমন উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে চাল রফতানি বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, দুই লাখ টন চাল রফতানি করা হলে খাদ্য অধিদপ্তরের স্থানীয় সংগ্রহে কোনো প্রভাব পড়বে না। চলমান যে বন্যা তাতেও সমস্যা হবে না। বন্যাকবলিত এলাকার যেসব বীজতলা নষ্ট হয়েছে অন্য এলাকা থেকে তা পুষিয়ে নেওয়া হবে। সরকারের যে মজুদ আছে তা বেশ সমৃদ্ধ। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার পরও সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে নিতে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি হবে না।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৭৩ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ কোটি ৭৭ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হওয়ার কথা। সেই হিসাবে দেশে ২৭ লাখ টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকবে। এরসঙ্গে যোগ হবে আমদানি করা খাদ্যশস্য।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৩ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুধু বোরো নয়, গত মৌসুমে আমন ও আউশের উৎপাদনও অনেক ভালো হয়েছে। ২০১৭ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে আউশ, আমন ও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ২০১৭ সালে হাওরে বন্যায় ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। অথচ ওই ঘটনা সামাল দিতে আমদানি করা হয়েছে ৩৭ লাখ টন খাদ্যশস্য। ওই সময় আমদানি উৎসাহিত করার জন্য সরকার ধাপে ধাপে আমদানি শুল্ক্ক ও সম্পূরক শুল্ক্ক প্রত্যাহার করেছে। আমদানি ও বাম্পার ফলনে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি চাল দেশে রয়েছে।