দেশের অন্যতম বড় শিল্প গ্রুপগুলোর একটি হচ্ছে প্রাণ-আরএফএল। সারাদেশে বিপুল কর্মসংস্থান ও রফতানিতে ভূমিকা রাখলেও অতিমাত্রায় সম্প্রসারণ দুর্বল করে ফেলছে প্রাণ-আরএফএলের আর্থিক সক্ষমতাকে। একই সঙ্গে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে দেশের এক-তৃতীয়াংশ ব্যাংকের। প্রায় একই পরিস্থিতি নাভানা, পারটেক্স, আবদুল মোনেমসহ দেশের বেশির ভাগ বৃহৎ শিল্প পরিবারের। খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে আছে অন্য শিল্প গ্রুপগুলোর ঋণও।
২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় পুনর্গঠন করা হয়েছিল ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। পুনর্গঠন করা সে ঋণেরও সিংহভাগই আবার খেলাপি হয়েছে। চলে গেছে ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিটের ‘স্ট্রেসড’ বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের তালিকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ মোট ঋণের ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৭ সালে এ হার ১৯ শতাংশ থাকলেও গত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই কথা বলছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের উচ্চহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়ত পুনঃতফসিলের পথে হাঁটছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃহৎ খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন। আইন অনুযায়ী কোনো ঋণ তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলের সুযোগ না থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। যদিও প্রভাবশালী গ্রাহকরা ১০ বারেরও বেশি পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়েছেন। এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা কম দেখালেও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার বেড়েছে। অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে ব্যাংকিং খাতের বিতরণকৃত ঋণের এক-চতুর্থাংশই দুর্দশাগ্রস্ত।
ব্যাংকিং খাতে ২০ শতাংশের বেশি স্ট্রেসড ঋণ সুস্থতার লক্ষণ নয় বলে মনে করছেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে স্ট্রেসড ঋণের বিদ্যমান হার অবশ্যই উদ্বেগজনক। ২০ শতাংশের বেশি স্ট্রেসড ঋণ থাকা সুস্থতার লক্ষণ নয়। স্ট্রেসড ঋণ কমানোর দুটি উপায়ের একটি হলো খেলাপি ঋণ থেকে আদায় বাড়ানো, অন্যটি অবলোপন করে ব্যালান্স শিটকে ভারমুক্ত করা। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ অবলোপন নীতিমালায় সংশোধনী এনে তিন বছরের আগে কোনো মন্দ ঋণ অবলোপন করা যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছে। এটি হলে স্ট্রেসড ঋণ আরো বাড়বে। এজন্য আমরা নীতিমালাটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছি।
সম্প্রতি ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, তিন থেকে সর্বোচ্চ নয় মাসের মধ্যে কোনো গ্রাহক কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, নয় থেকে ১২ মাস পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ না হলে সন্দেহজনক এবং ১২ মাস বা এর বেশি সময়েও কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে ঋণকে মন্দমানের খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়। শ্রেণীকৃত এ ঋণই খেলাপি হিসেবে বিবেচিত। কোনো গ্রাহক খেলাপি হওয়ার পর ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারেন না। গ্রাহককে সুবিধা দিতেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এছাড়া ২০১৫ সালে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন গ্রুপগুলোকে তা পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। এসব ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফের তথ্য বলছে, ২০১৩ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ওই বছর শেষে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনকৃত ঋণ ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে ২০১৩ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। এর পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকলেও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ১ লাখ ৭ হাজার ২৬০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে রেকর্ড ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে গত বছর। এর আগে ২০১৭ সালে ১৯ হাজার ১২০ কোটি, ২০১৬ সালে ১৫ হাজার ৪২০ কোটি, ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ১৪০ কোটি, ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৩৫০ কোটি ও ২০১৩ সালে ১৮ হাজার ২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল। এছাড়া ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় পুনর্গঠন করা হয়েছিল ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। একই সময়ে ৯২ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা ছিল পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণ বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ (স্ট্রেসড লোন)। এ হিসাবে গত বছর শেষে ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা।
ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণ ছিল ৯ লাখ ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত এ ঋণের হার ক্রমেই বাড়ছে।
২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনকৃত ঋণের ৭৫ শতাংশই বড় শিল্পে। গত ডিসেম্বর শেষে দেশের বৃহৎ শিল্পে ব্যাংকঋণ ছিল ৪ লাখ ৩২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকার। এর মধ্যে খেলাপির খাতায় উঠেছে ৩৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকার ঋণ। একই সময়ে বৃহৎ শিল্পের ৭০ হাজার ১৫০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। সে হিসাবে বৃহৎ শিল্পে বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ দুর্দশাগ্রস্ত। যদিও মাঝারি শিল্প খাতে এ হার ১৯ দশমিক ৫ ও ছোট শিল্পে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। স্ট্রেসড ঋণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। এ খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ১২ দশমিক ৪ শতাংশ স্ট্রেসড।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খেলাপি ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণ আরো বেড়েছে। মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আরো ৫ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে অবলোপনকৃত ঋণ রয়েছে ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকার।
বেশি মাত্রায় স্ট্রেসড ঋণ ব্যাংকগুলোর সমৃদ্ধির পেছনে টেনে ধরছে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান। তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতের অনুকূলে। বেশির ভাগ ব্যাংক ভালো ব্যবসা করছে, মুনাফাও ভালো। কিন্তু স্ট্রেসড ঋণ প্রায় সব ব্যাংককেই পেছন থেকে টেনে ধরছে। ব্যাংক ও গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার্থে পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। কিন্তু পুনঃতফসিলকৃত ঋণ খেলাপি হয়ে বিপদ বাড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসা দরকার। ঋণ পরিশোধ না বাড়ালে দুই পক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। তবে সম্প্রতি ঋণ অবলোপন নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে মন্দমানের যেকোনো ঋণের বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতি রেখে ব্যাংকগুলো অবলোপন করতে পারত। কিন্তু নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি হওয়ার পর তিন বছর অতিক্রান্ত না করা পর্যন্ত কোনো ঋণ অবলোপন করা যাবে না। যদিও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নীতির বিরোধিতা করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সব ব্যাংক এমডির বৈঠকে ঋণ অবলোপনের নীতিমালায় সংশোধনী আনার দাবি জানানো হয়।
ব্যাংক এমডিদের যুক্তি হলো, কোনো ঋণ অবলোপন করার ক্ষেত্রে শতভাগ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয়। ফলে আমানতকারীদের অর্থও শতভাগ নিরাপদ থাকছে। খেলাপি হওয়ার পর তিন বছরের আগে কোনো ঋণ অবলোপন করা সম্ভব না হলে ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিটে খেলাপি ঋণ বেশি দেখাবে। পুনঃতফসিল করে দিলেও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার বাড়বে। ব্যাংক এমডিদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ অবলোপনের নীতিমালাটি পুনর্মূল্যায়ন করার আশ্বাস দিয়েছে।