বাম দলই আমার সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ করেছে:তসলিমা

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০১৯-০৮-২০ ১৮:০৭:৫৬


যে আমি বাম-ঘেঁষা বা বামপন্থী, সেই আমার সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ করেছে বাম দলই। আমার কাছ থেকে আমার শেষ সম্বল আমার বাংলাকে কেড়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন। তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে এ কথা জানান। পাঠকদের জন্য তসলিমা নাসরিনের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:-

আমি ডানপন্থী কখনও ছিলাম না। বাম-ঘেঁষা চিন্তাভাবনা বরাবরই ছিল। কোনওদিন পার্টি করিনি। কৈশোর পার হওয়ার পর ময়মনসিংহ শহরে দুটো দল যা গড়েছিলাম তা নিতান্তই শিল্প সাহিত্য বিষয়ক। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন শতাব্দি চক্র, তারপর সকাল কবিতা পরিষদ।

আরও একটা দল গড়েছিলাম সেটির নাম ধর্মমুক্ত মানববাদি মঞ্চ, সেটি কলকাতায়, শিক্ষিত সচেতন ধর্ম মুক্ত মুসলমান সমাজের নারী পুরুষদের নিয়ে। এটি গড়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু নেপথ্যে ছিলাম। নেপথ্যে ছিলাম কারণ তখন নোংরা রাজনীতি চলছে আমাকে নিয়ে, বাম দল আমার বাম -ঘেঁষা বই নিষিদ্ধ করেছে। ভয় ছিল মুসলমানদের মানুষ বানাচ্ছি এই অভিযোগে মুসলিম মৌলবাদি দল গুলো আমার বিরুদ্ধে আবার পথে না নামে।

আরো পড়ুন:মেয়েদের ব্যায়াম-সাজগোজ এখন ছেলেদের দখলে

আমাকে ভারত বাংলাদেশের কোনও রাজনৈতিক দলই কখনই পছন্দ করেনি। যে আমি বাম-ঘেঁষা বা বামপন্থী, সেই আমার সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ করেছে বাম দলই। আমার কাছ থেকে আমার শেষ সম্বল আমার বাংলাকে কেড়ে নিয়েছে। বাম দলের জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য , বিমান বসুর সংগে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। তাঁদের সহানুভূতি সাহচর্যও পেয়েছি। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আমার বই নিষিদ্ধ করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমার মুখ দেখা বন্ধ করলেন।

দু বছর পর কলকাতা হাইকোর্ট বইটিকে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি দেওয়ার পর শুরু হলো আমার ৭ নম্বর রওডন স্ট্রিটের বাড়িতে ঘন ঘন পুলিশের ফোন, পুলিশের বড়কর্তার সশরীরে আসা, আমাকে রাজ্য ছাড়ার আদেশ দেওয়া, নিরাপত্তা উঠিয়ে দেওয়ার হুমকি। আদেশ মানিনি বলে গৃহবন্দি করা হলো আমাকে।

চার মাস গৃহবন্দি করে রাখার পর বাম নেতারা আয়োজন করলেন চোর ছ্যাচড়দের পথে নামানোর, কাগজে ‘তসলিমা গো ব্যাক’ লিখে টেলিভিশনের সামনে ধরে রাখার ব্যবস্থা করলেন, খামোকা আর্মি নামালেন, বিমান বসু বললেন, আমাকে যদি ওই চোর ছ্যাচড়্গুলো পছন্দ না করে, তা হলে আমি চলে যাই না কেন রাজ্য ছেড়ে! রাস্তার নাটকটি চলার অনেক আগে থেকেই কিন্তু আমার বাড়িতে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন মূখ্যমন্ত্রীর হুমকিবাহক প্রসূন মুখার্জি , বিনিত গোয়েল।

৭ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে আমাকে নিরাপত্তা পুলিশেরা উঠিয়ে নিয়ে খোলা একটি বাড়িতে রেখে চলে গেলেন। বলে গেলেন সিদিকুল্লাহ মিছিল নিয়ে আমাকে মারতে আসছে, বলে গেলেন একটা টেররিস্ট দল আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছে। সারাদিন আমি নিরাপত্তাহীন বাড়িটিতে বসে রইলাম।

এই হচ্ছে বাম রাজনীতি, আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, ভয়ে তটস্থ হয়ে যেন নিজে থেকে রাজ্য ছেড়ে চলে চাই। আমাকে লোকে চেনে বলে আমাকে মেরে ফেলেননি ওঁরা, নাহলে মেরেই ফেলতেন বোধহয়। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সে বাড়ির মালিককে দিয়ে বলালেন বাড়ি ছাড়তে। আমার একার প্রতিরোধে শেষ অবধি কাজ হয়নি। একদিন ঠিকই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করলেন। একটা ফ্রি ওয়ান ওয়ে টিকিট হাতে ধরিয়ে দিলেন ।

আমাকে রাজ্যছাড়া করেও বাম রাজনীতি শান্ত হয়নি। কেন্দ্রে বাম রাজনীতিকদের একজন ঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন। তাঁকে দিয়ে আমাকে দেশ ছাড়া করার নানা রকম কায়দা কানুন শুরু হয়ে গেল। গৃহবন্দিত্ব থেকে শুরু করে মানসিক নির্যাতন। অতঃপর কিছুতেই কাজ না হলে শারীরিক। ডাক্তার দেখানো চলবে না।

ওষুধ খাওয়া চলবে না। ব্লাড প্রেসার আকাশে উঠছে উঠুক। চিল্লাচিল্লি করার পর ডাক্তার দেখানো হলো বটে, ওঁদের তিন ওষুধের একটি খেয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলাম। এইমসের সিসিউতে একজন নিয়ে এলেন।তাঁর কিন্তু আমাকে সাহায্য করার কথা ছিল না। কর্তাদের আদেশ অমান্য করেই নিয়ে এলেন। ওখানে জীবন বাঁচানোর চিকিৎসা চললো, ডাক্তার বেহাল বললেন, ওষুধের ‘পয়জনাস রিয়েকশান’ হয়েছে, সপ্তাহ দুই লাগবে ব্লাড প্রেসার স্টেবল হতে। কিন্তু বাম রাজনীতিকদের সেই শুভাকাংখী আমাকে পরদিনই বের করে নিলেন হাস্পাতাল থেকে।

প্রচণ্ড ফ্লাকচুয়েট করা ব্লাড প্রেসার নিয়ে ঘরে বসে থাকতে হলো। এইমসের কোনও ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। কষ্টে সৃষ্টে অন্য এক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। সেই ডাক্তারও দুদিন পর হাওয়া। পরে শুনলাম সেই ডাক্তারের কাছে পুলিশ গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছে, আমার সঙ্গে যেন ফোনে কথা না বলে। গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল আমার। আমি যদি দেশ না ছাড়ি, আমাকে তো মেরে ফেলবে এরা।

স্টালিনের গুলাগের কথা মনে পড়লো।২০০৮ সালে আমি জীবন বাঁচাতে ভারত ছাড়তে বাধ্য হলাম । তারপরও আমি কিন্তু বাম পন্থী। আমি সমতায় সাম্যে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি ধর্ম মানি না, কাস্ট মানি না, গরিব ধনী মানিনা, বৈষম্য মানি না, সমতার সমাজে বিশ্বাস করি, এই বিশ্বাসের কথা লিখি আমি , আমি বাম না তো ওঁরা বাম?

মাঝে মাঝে আমার জানতে ইচ্ছে হয় পশ্চিমবংগের বামফ্রন্ট সরকার কেন আমাকে দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য অমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল?

১। পঞ্চায়েত নির্বাচনে মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য? ইসলাম বিরোধীকে তাড়িয়েছি, আমাদের ভোট দে এইবার? কিন্তু আমি কোন ছার? মুসলমানদের ক’জন চেনে আমাকে?
২।দ্বিখণ্ডিত নিষিদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু দুবছর পর হাইকোর্ট বাতিল করেছিল বলে নিষেধাজ্ঞা ? কিন্তু নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা তো আমি করিনি। করেছে এপিডিআর।

৩। সুনীল গংগো বন্ধু বুদ্ধ’র কাছে বায়না ধরেছিলেন যে করেই হোক আমাকে রাজ্যছাড়া অথবা দেশ্ছাড়া করতে হবে, যেহেতু দ্বিখণ্ডিততে যেভাবে বাংলাদেশের মহাপুরুষদের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে, পরের খণ্ডে পশ্চিম্বংগের মহাপুরুষদের মুখোশ সেভাবে উন্মোচন হওয়ার আশংকা আছে বলে? তাই আপদটাকে পগারপাড় করতে হবে? কিন্তু তিনি কি এত নিচে নামবেন?

কোন কারণটি আসল কারণ জানি না। দ্বিখণ্ডিততে ইসলাম নিয়ে মন্তব্য আছে, কিন্তু ওই নাস্তিক বামেরা কি ইসলাম বিশ্বাসী যে সহ্য করতে পারেননি? মুসলমানের মনে আঘাত লাগবে বইটি পড়লে এটি ফালতু কথা। কোনও মুসলমানই মিছিল করেনি, দাবি করেনি বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য। দ্বিখণ্ডিততে সবচেয়ে বেশি আছে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা । দ্বিখণ্ডিত সেকুলারিজমের পক্ষে, মানবতার পক্ষে , নারীর সমান অধিকারের পক্ষের একটি বই। এগুলোতে তো বামপন্থীদের বিশ্বাস করার কথা!

আমি আসলে পশ্চিমবংগের বাম রাজনীতিকদের চেয়ে বাম পন্থায় বেশি বিশ্বাস করি। আমার ভিতরে ভণ্ডামো হিপোক্রেসি এসব নেই। এখনও বামের পক্ষে লিখি। যাঁরা বৈষম্যহীন সমতার সমাজের পক্ষে লড়াই করা আমাকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করেছেন তাঁরা সত্যিকার বাম পক্ষের লোক নন। লোক নন বলেই দলে দলে শুনি অনেকে বিজেপিতে ভিড়েছেন। কই, আমি তো আমার আদর্শ থেকে এক চুল সরিনি! আমি কে? সাধারণ একজন মানুষ। অসহায়, নিরীহ। কেউ নেই পাশে আমার মতোই সাধারণ কিছু মানুষ ছাড়া। আমার কাছে কত ছোট হয়ে গেলেন না ওঁরা? মস্ত মস্ত ওঁরা?