মানবজাতি সৃষ্টির আগে মহান আল্লাহ তায়ালা মানববান্ধব পৃথিবী তৈরি করেন। আকাশ-বাতাস, চন্দ্র-সূর্য, সাগর-মহাসাগর, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, ফুল-ফল, বৃক্ষলতা দিয়ে সাজানো-গোছানো এ সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেন। তারপর ধন্য এই ধরণীতে মহান আল্লাহ তায়ালা অগণিত প্রজাতির প্রাণী সৃষ্টি করেছেন।
এর মধ্যে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সর্বোত্তম জাতি হিসেবে এই ধরাধামে প্রেরণ করেছেন, যাতে তারা সুকোমল স্বভাব-চরিত্র ও পরোপকার ব্রত নিয়ে এখানে একটি সুন্দর ও সুশীল সমাজ গঠন করতে পারে। যে সমাজে থাকবে না হিংসাবিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা। থাকবে না পরস্পরে মারামারি, কাটাকাটি ও হানাহানি। এহেন সুন্দর পরিবেশে থেকে সে নির্বিঘেœ পরকালীন পাথেয় জোগাড় করতে পারে।
মানবজাতির জীবন দর্শন ও সমাজের রূপরেখা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য অনুপম আদর্শ হিসেবে তিনি যুগে যুগে তাঁরই মনোনীত বান্দাদের নবী-রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন এ ধরায়। আর তাঁর নিয়মনীতি ও আইনকানুনস্বরূপ নাজিল করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে কিতাব। কিন্তু মানুষ আল্লাহর মনোনীত সেসব নবী-রাসূলের তিরোধানের পর আল্লাহর সব বিধান বিসর্জন দিয়ে খুন, হত্যা, মারামারি, দখলসহ অন্যায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আদর্শিক শিক্ষা পরিত্যাগ করে শয়তান ও কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব শুরু করে দেয়।
ফলে শুরু হয় তাদের নৈতিক অবক্ষয়। হজরত রাসূলে করিম সা:-এর আবির্ভাবের আগের সময়টি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরতম ও জাহেলিয়াতের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি যুগ। মানবসভ্যতা এ সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি, লুটতরাজ, জুলুম-নির্যাতন, ব্যভিচার-ধর্ষণ প্রভৃতি অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়ে ওঠে তাদের নিত্যনৈমিত্তিক আচার-আচরণ। শুধু তাই নয়, এগুলোই হয়ে ওঠে তাদের বীরত্ব ও পৌরুষত্বের পরিচায়ক।
রাতের অন্ধকারে কোনো কবিলায় হানা দিয়ে তাদের সর্বস্ব হরণ করে দ্রুত প্রস্থান করা ছিল রীতিমতো গর্বের বিষয়। ব্যভিচারের রগরগে বর্ণনাকে গণ্য করা হতো পৌরুষত্ব হিসেবে, যা তখনকার যুগের খ্যাতিমান কবি ইমরুল কায়েস, শানফারা প্রমুখ জাহেলি যুগের কবিদের কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। কোনো কূপে পশুর পানি পান করার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেধে যেত গোত্রে গোত্রে লড়াই। আর তা শুধু মাসের পর মাস নয়, বছরের পর বছর এমনকি যুগের পর যুগ ধরে চলত। নিজ কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়েও কোনো রূপ বিবেকের দংশন অনুভব করত না তারা।
অন্যায় অপরাধে নিমজ্জিত জাহেলিয়াতের ঘোর অন্ধকার থেকে মানুষকে উদ্ধারের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা প্রেরণ করলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-কে। প্রেরণ করলেন বিশ্বশান্তির ধর্ম ইসলাম ও মহাগ্রন্থ আল কুরআন। ইসলামের জাদুময়ী আবেদনে ছিল চিরশান্তির পরশ। মানবসভ্যতা বিকাশের যতগুলো সৎগুণের প্রয়োজন, ইসলামে তার সবই প্রদান করা হলো। আর নীতিনৈতিকতা ধ্বংসের পেছনে, মানুষকে পশুস্বভাবে উদ্বেলিত করতে যতগুলো দোষ ও অপকর্ম ক্রিয়াশীল তা শুধু নিষেধই করা হলো না, তার মূলোৎপাটনে দেয়া হলো দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা।
সব অপকর্মের মূল মদ-জুয়া, সুদ-ঘুষ প্রভৃতিকে আখ্যায়িত করা হলো শয়তানের কাজ বলে এবং তা বর্জন করার কঠোর নির্দেশ দেয়া হলো। ইরশাদ হলো, ‘হে মুমিনগণ! মদ-জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি, ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা মায়েদা : ৯০)। ব্যভিচারকে অশ্লীল কাজ আখ্যা দিয়ে তার ধারে-কাছে যেতেও নিষেধ করা হলো।
‘ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (১৭:৩২)। অনুরূপভাবে হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অপহরণ, এতিমের সম্পদ গ্রাস প্রভৃতি সব মন্দকাজ ইসলামে সুস্পষ্ট ভাষায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অশ্লীলতা ও মন্দকাজ দূর করার জন্য ইসলামে নামাজ ফরজ করে দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছেÑ ‘নামাজ কায়েম করো। নামাজ অবশ্যই বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে।’ (২৯:৪৫)।
ইসলাম প্রবর্তিত এসব কর্মসূচি ও পদক্ষেপের ফলে এবং ইসলামী আদর্শের আকর রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত রাসূলে করিম সা:-এর পবিত্র সাহচর্যের পরশে দ্রুততম সময়ে নৈতিক অবক্ষয়ের পঙ্কিলতায় ডুবে যাওয়া মানুষেরা পরিণত হলেন সোনার মানুষে। তাদের সেই কলুষিত পরিবেশ ও সমাজ পরিণত হলো সুবাসিত পরিবেশ এবং কল্যাণময় সমাজে। ইতিহাস ও সিরাত গ্রন্থগুলোর পাতায় পাতায় এর ভূরি ভূরি নজির আজ আমাদের সামনে উদ্ভাসিত।
তাই দেখা যায়, তাবুকের ময়দানে দুপুরের খরতাপে পড়ে আছেন কিছু আহত ও রণক্লান্ত মুসলিম মুজাহিদ। পিপাসায় ছাতি ফেটে যাওয়া এক মুজাহিদ চিৎকার দিয়ে উঠলেন ‘পানি, পানি’ বলে। তার চাচাতো ভাইয়ের কানে আওয়াজ পৌঁছলে তিনি পানির পাত্র নিয়ে ছুটে যান তার কাছে। আহত মুজাহিদ পান করার জন্য পাত্রটি মুখের কাছে তুলে ধরেছেন অমনি তার কানে এলো পানির জন্য আরেক আহত মুজাহিদের কাতর কণ্ঠস্বর। সাথে সাথে তিনি পাত্র নামিয়ে বললেন, পানিটুকু ওই ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। আমার থেকে তার প্রয়োজন বেশি। বাহক পানি নিয়ে ছুটলেন তার কাছে।
তিনি পানপাত্র মুখের কাছে নিয়েছেন, অমনি শুনতে পেলেন পাশে আরেক মুজাহিদ ‘পানি, পানি’ বলে কাতরাচ্ছেন। তখন তিনিও পাত্রটি ফেরত দিয়ে বললেন, ওই ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও, তার প্রয়োজন বেশি। বাহক পানির পাত্র নিয়ে ছুটলেন তার কাছে। কিন্তু গিয়ে দেখলেন তার পৌঁছার আগেই তিনি শাহাদতের অমিয় সুধা পান করে এ দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে গেছেন। ছুটে এলেন দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে। দেখলেন, তিনিও চিরবিদায় নিয়েছেন এ ধরার বুক থেকে। ছুটলেন তার সেই চাচাতো ভাইয়ের কাছে। এসে দেখলেন তিনিও পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। যে জাতি কিছু দিন আগেও ছিল ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু, পরসম্পদ হরণকারী; কোন জাদুর পরশে তারা এত আত্মত্যাগী ও মানবতাবোধে উদ্বেল হয়ে উঠল? নিশ্চয়ই তা হলো ইসলামের সুমহান শিক্ষা।
তৎকালীন পরাশক্তি পারস্যের রাজধানী মাদায়েন মুসলিমদের হাতে বিজিত হয়। সেখানকার হাজার বছরের প্রাচীন রাজভাণ্ডার গণিমতের মাল হিসেবে মদিনায় প্রেরিত হয়। মসজিদে নববীর সামনে তা স্তূপ করে রাখা হয়। সোনা-রূপা, হীরা-জহরত, মণি-মাণিক্যের এত বিশাল সে ধনভাণ্ডার যে, মসজিদে নববী তার আড়ালে পড়ে গেল। খলিফা উমর রা: সে ধনরাশির ওপর হাত রেখে কেঁদে ফেললেন।
বললেন, ধন্য সে মুসলিম জাতি, যারা এর একটি কপর্দকের ওপরও লোভ করে আমানতের খেয়ানত করেনি। কিছু দিন আগেও যে মানুষ অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন ও সর্বস্ব অপহরণের জন্য মরুভূমির বুকে, পর্বতের আড়ালে ওঁৎ পেতে বসে থাকত, গভীর রাতে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বেরিয়ে পড়ত। কিছু দিনের ব্যবধানে কিসে তাদের এমন নির্লোভ ও নির্মোহ সোনার মানুষে পরিণত করে দিলো? নিশ্চয়ই তা হলো ইসলামের অনুপম শিক্ষা।
ইতিহাসের পাতা খুললে এ রকম অসংখ্য ঘটনার সন্ধান পাওয়া যাবে, যাতে প্রতীয়মান হয়, চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি, জুলুম-নির্যাতন, ব্যভিচার-ধর্ষণ প্রভৃতি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে আকণ্ঠ নিমজ্জিত তথা নৈতিক অবক্ষয়ের রাহুগ্রাসে পতিত বর্বর মানুষকে চারিত্র্যিক সুষমামণ্ডিত ও অনুপম চরিত্র মাধুরীতে উন্নীত করেছিল ইসলামের শান্তিময় সুমহান শিক্ষা।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, আজ সারা বিশ্বে যে মারামারি-হানাহানি চলছে, সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের যে তাণ্ডব চলছে, নৈতিক অবক্ষয়ের যে সয়লাব বয়ে চলছে; তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একমাত্র পথ হলো ইসলাম। ইসলামের নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন হলে এখনো শান্তি ও কল্যাণময় সমাজ গঠন করা সম্ভব। সম্ভব দুর্নীতি ও কলুষতামুক্ত অনাবিল শান্তির বিশ্ব গঠন।
তাই আসুন, আমরা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ তথা সর্বক্ষেত্রেই ইসলামের নীতি-আদর্শ পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করে উভয় জাহানের শান্তি ও কামিয়াবি হাসিল করি।
লেখক : সাংবাদিক