বাজারে ভিড় করেছে বড় ইলিশ
:: আপডেট: ২০১৯-০৯-০২ ১৩:২৬:১০
বর্ষা সিজন শেষ হয়ে ভাদ্র শুরু। নদীতে এখন ইলিশ মাছ ধরতে ব্যস্ত জেলেরা। বাজারে এখন ইলিম মাছের ছড়া-ছড়ি। বাঙালির রসনা-বিলাসে বাড়তি খরচ করে হলেও এই মাছটি কিনতে আপত্তি থাকেনি কখনো। আর মাছবাজারে এখন ইলিশের দোকানিগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যস্ত।
আর এর চেয়ে কম আকারের হলে দাম আরও কম। যাদের সামর্থ্য কম তারা তুলনামূলক কম, তাদের কিনতে হচ্ছে ছোট আকারেরগুলো। যদিও মনে বাসনা নিয়ে যাবেন বড়গুলো।
বছর কয়েক আগেও এক কেজি বা কাছাকাছি ওজনের ইলিশ ছিল তুলনামূলক কম। তবে এখন বাজারে এখন দাপট বেশি বড়দেরই। আর কদরও বেশি এই ৯০০ থেকে এক হাজার বা তার চেয়ে কিছু বেশি ওজনের ইলিশের।
করে মৎস্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকো ফিশ প্রকল্পের জরিপ অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশের ইলিশের গড় আকৃতি ও ওজন বেড়েছে। ২০১৪ সালে ধরা পড়া ইলিশের গড় ওজন ছিল ৫১০ গ্রাম। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৮০ গ্রাম। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে ধরা পড়া মাছের গড় ওজন বেড়েছে ৩৭০ গ্রাম।
একই সময়ে ধরা পড়া আধা কেজি থেকে এক কেজি ইলিশের সংখ্যা ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৭ শতাংশ হয়েছে। আর জাটকা ধরার পরিমাণ ৬০ শতাংশ থেকে কমে ১৩ শতাংশ হয়েছে। আকার বাড়ার পাশাপাশি উৎপাদনও বাড়ছে। যদিও দেড় যুগ আগের চিত্রটা ছিল ঠিক উল্টো।
২০০২-০৩ অর্থবছরে দেশে দুই লাখ টনের কম ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল। পরের বছর উৎপাদন কমে এক লাখ ৩৩ হাজার ৩২ টনে নেমে আসে। এর পর থেকে জাটকা রা কর্মসূচিতে জোর দেয় সরকার। এতে উৎপাদন কিছুটা বাড়তে থাকে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুই লাখ ৯৮ হাজার ৯২১ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এর পর মা-মাছ রক্ষার কর্মসূচি আরও জোরদার করলে ইলিশের উৎপাদন তিন লাখ টন ছাড়িয়ে যায়।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে তিন লাখ ৮৫ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। পরের বছর তা হয় চার লাখ টনের বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে হয় সাড়ে চার লাখ টন। গত বছর উৎপাদন আরো বেড়ে হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার টন হয়েছে। গত বছর বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৮৬ শতাংশ ছিল বাংলাদেশের।
চলতি বছরের প্রাথমিক হিসাব না এলেও মৎস্য বিভাগ আশা করছে উৎপাদন এবার সাড়ে পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।
ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকো-ফিশ প্রকল্পের প্রধান ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘সরকারের সুব্যবস্থাপনার ফলে জাটকা নিধন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ইলিশগুলো সাগরে যেতে পারছে। ফলে তারা বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।’
‘আবার ২২ দিন যে মা মাছ মরা বন্ধ থাকছে তাতে অনেকগুলো মাছ জীবনের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে পোনা ছেড়ে সাগরে ফিরে যেতে পারছে। আবার সে ফিরে আসছে। অর্থাৎ মা মাছ রক্ষার যে সময়, সেটা সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে বিধায় অসংখ্য মাছ দ্বিতীয় বছর, তৃতীয় বছরে আসছে বিধায় মাছের আকার বড় হয়ে যাচ্ছে।’
যারা ইলিশ পছন্দ করেন, তাদের জন্য আরো একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ; তথ্য দিয়েছেন এই মৎস্যবিদ। জানান, ৯০০ থেকে এক হাজার একশ গ্রাম ওজনের ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে বেশি। কারণ, এটি পুরো যৌবনপ্রাপ্ত মাছ।
চাঁদপুরের ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আখেরী নাইমা বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরেই ইলিশ ধরার পরিমাণ বাড়ছে। পৃথিবীর যেসব দেশে এই মাছটি পাওয়া যায়, সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশের চিত্র পুরো উল্টো। কেবল পরিমাণেই বেশি হচ্ছে না, ইলিশের আকারও আগের চেয়ে বড় হচ্ছে।’
এই পরিবর্তন কীভাবে হলো- এমন প্রশ্নে এই ইলিশ গবেষক বলেন, ‘জাটকা (বাচ্চা ইলিশ) নিধন বন্ধে তৎপরতা আর কিছুদিন পরে যখন মাছ ডিম দেবে, সে সময় মা ইলিশ শিকার বন্ধের যে নির্দেশ আসে, সেগুলো এখন কড়াকড়িভাবে পালিত হয়। যে কারণে ইলিশ এখন আগের চেয়ে বেশি ডিম দিচ্ছে।’
‘জাটকা শিকার ৬৫ দিন বন্ধ থাকায় মাছগুলো বড় হতে পারে। ২২ দিন মা ইলিশ শিকার বন্ধ থাকবে বলে বাচ্চার সংখ্যাও বাড়ে।’
দাম ‘গতবারের চেয়ে কম’
কারওয়ানবাজারে বিষ্ণু হালদার নামে এক ব্যবসায়ী জানান, গতকাল বাজারে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের পাইকারি মূল্য ছিল এক হাজার সাতশ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত বছর এই ইলিশ বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৬০০ থেকে তিন হাজার টাকা।
গতকাল এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম নয়শ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। বিষ্ণুর তথ্যমতে গত বছর এই আকারের ইলিশের দাম ছিল এক হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার হাজার টাকা।
সাত থেকে আটশ গ্রাম সাইজের ইলিশের দাম দেখা গেছে সাত থেকে আটশ টাকা। গত বছর এগুলো বিক্রি হয়েছে এক হাজর ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা।
৫০০ গ্রামের ইলিশগুলো কেজি বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। যা গত বছর ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় ।
কারওয়ান বাজারের এক আড়তদার জানান, বড় আকারের যেসব মাছ ধরা পড়ে, তার বেশির ভাগই বিদেশে চলে যায়। নইলে দাম আরও কমত।
ইলিশ মাছের বাজার চিত্র:-
কারওয়ানবাজারের খুচরা দোকানিরা এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি করছিলেন নয়শ থেকে এক হাজার টাকায়। এক হাজার দুই বা তিনশ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকায়।
বেসরকারি চাকরিজীবী আমির হোসেন বলেন, ‘বাজারে মাছ আছে, তারপরও মাছের কাছে ভিড়তে পারছি না। নামেই ভরা মৌসুম। ‘বাজারে ইলিশের ছড়াছড়ি। কিন্তু এক কেজি হলেই এক হাজার টাকা চাইছে। হাজার বারশ টাকা দিয়ে একটা মাছ কেনার সাধ্য কি সবার আছে?
আবুল হোসেন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘ইলিশ এখন বড়লোকের খাবারে পরিণত হয়েছে। গরিব মানুষতো কিনতে পারে না, এখন এটা আর তাদের খাবার না।’
‘এ বছর ইলিশের দাম তুলনামূলক কম। তবে প্রচুর সরবরাহ, দাম আরও একটু কমলে ভাল হতো। আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষ কিনে খেতে পারত।’
হামিদ নামের আরেক ক্রেতা বলেন, ‘যে দামে বিক্রি করছে তা আমাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষ কিনতে পারছি না।’
যাত্রাবাড়ীর মৎস্য আড়তদার বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘ভরা মৌসুম চললেও জেলেদের জালে ইলিশ তেমন ধরা পড়ছে না। তবে চাহিদার তুলনায় বাজারে এখনও সরবরাহ বড়েনি। সে কারণেই দাম বেশি।’ এই আড়ৎদার অবশ্য মনে করেন, সামনে ইলিশের সরবরাহ বাড়বে আর দাম আরো কমে আসবে।
কারওয়ানবাজারের বিক্রেতা ভিশনু হালদার বলেন, বাজারে ইলিশের অভাব নাই। ‘গত দুই মাস ইলিশ ধরা বন্ধ আছিল। এহন মাছ ধরা পড়লেও দাম ছাড়তে চায় না আড়তদাররা। আমাদেরও বেশি দামে মাছ কিনতে হয়। তবে চাহিদা প্রচুর। এই জন্য দাম কেউ ছাড়তে চায় না। যদিও গত কয়েক বছরের চেয়ে এই বছর দাম একটু কম।’
সানবিডি/এসএস