এত ‘উন্নয়ন’ লইয়া আমরা কি করিব?
:: প্রকাশ: ২০১৯-০৯-০৭ ১৩:৪৬:০৫
ছবিটা দেখে প্রথমে মনে হতে পারে, পড়া না পারায় কিংবা দুষ্টুমি করায় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বুঝি দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি দিচ্ছেন কোন শিক্ষক! ঘটনা কিন্ত তা নয়। স্কুলের সামনের রাস্তাটা ডুবে গেছে ময়লা পানিতে, সেই নোংরা পানি আর কাদার হাত থেকে বাঁচতেই রাস্তার উঁচু একপাশে বিছিয়ে রাখা বস্তার সারি ধরে দেয়াল ঘেঁষে হেঁটে চলেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। একদিন-দুদিন নয় এই অবস্থা চলছে গত তিন বছর ধরেই। নোংরা পানির দুর্গন্ধে স্কুলে বসা দায়, এরইমধ্যে চলছে ক্লাস-পরীক্ষা সবকিছুই।
নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর চাষাড়া এলাকার ইসদাইর রাবেয়া হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা এটা। গত তিন বছর ধরেই এই বেহাল দশা রাস্তাটির। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার বাছবিচার নেই, সারাবছরই রাস্তা ডুবে থাকে নোংরা কাদা-পানিতে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে এলাকাটা। সড়ক সংস্কার, ড্রেন নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ- সবকিছুর জন্য তিনটি সংস্থা থাকলেও দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ। ফলে বছরের পর বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ভুগছে এই রাস্তা।
রাস্তার একপাশে বস্তা ফেলে পায়ে হেঁটে চলাচল করা গেলেও কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। মাত্র আধা কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে কোনো রিকশার ভয়ে প্রবেশ প্রবেশ করে না। এলাকার ছোট দোকান ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এই এলাকার মানুষের চলাচলের একমাত্র উপায় হচ্ছে পায়ে হেটে চলাচল করা।
এই পথ ধরেই স্কুলে যেতে হয় এলাকার শত শত শিক্ষার্থীকে, শরীর নোংরা হয়ে যাওয়ার ভয়ে দেয়াল ঘেঁষে উঁচু একটুখানি পায়েচলা পথ ধরে দলবেঁধে হেঁটে চলে তারা, তাতেও অনেক সময় শেষরক্ষা হয় না। প্রায় আধ কিলোমিটার রাস্তা এখনও নোংরা পানির নিচেই তলিয়ে আছে। নাকে হাত চেপে ছোট ছোট শিশু কিশোরেরা এই পথ ধরে হেঁটে যায় পড়ালেখা করতে, এরচেয়ে বড় প্রহসন আর কি হতে পারে, সেটা আমাদের জানা নেই।
এই রাস্তার একপাশের জায়গার মালিক এলজিইডি, অন্যপাশটা সেনাবাহিনী অবৈধ দখলমুক্ত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করছে। ফলে এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে’ বলে পাশ কাটিয়ে যান। একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপান, তাদের ব্লেমগেমের বলি হয় সাধারণ জনগন, স্কুলগামী শিশু-কিশোরেরা।
সরকারের এমপি-মন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের কথা শুনলে মনে হয়, উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভেসে যাচ্ছে। এক মন্ত্রী জিডিপির উদাহরণ দেখালে আরেকজন ব্যাংকের বৈদেশীক মূদ্রা রিজার্ভের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, গত তিন বছর ধরে জিডিপি ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও রাবেয়া হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাটা ঠিক হয়নি। ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে, রাস্তা থেকে নোংরা কাদাপানি সরেনি। তাহলে জিডিপি বা ব্যাংক রিজার্ভ দিয়ে আমাদের কি লাভ বলুন?
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে কয়েকদিন আগে দেখলাম গান গাইতে, ছাত্রলীগকে নিয়েই সেই গান। সেখানে একটা লাইন ছিল- ‘ষড়যন্ত্রের নীল নকশা, নিন্দুকেরই প্রহসন; ভেদ করে করবো আমরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন… সেই ভিডিওতে একজন কমেন্ট করেছিলেন- ‘উন্নয়ন শব্দটা যত জোর দিয়ে বললো, ততটুকু জোর দিয়েও যদি তারা উন্নয়নটা করতো…’ চাষাড়ার রাবেয়া হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এই দুর্দশা দেখে সেই কমেন্টের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ!
পদ্মাসেতু দিয়ে ক’দিন পরে গাড়ি চলবে, মেট্রোরেলে চড়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়া যাবে আধঘন্টায়। আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু করতে পারি, মেট্রোরেলের মতো বিশাল প্রোজেক্ট হাতে নিতে পারি, অথচ নারায়ণগঞ্জের মতো জায়গায় একটা স্কুলের সামনে তিন বছর ধরে নোংরা পানি জমে আছে, স্কুলে যাওয়ার জন্যে বাচ্চাগুলোকে যুদ্ধজয় করতে হয়, এই সমস্যাটার সমাধান আমারা করতে পারলাম না? তাহলে এত উন্নয়নের বুলি শুনিয়ে কি লাভটা হলো বলুন তো? এই উন্নয়নের কি কোন মানে আছে?
লেখক: ব্লগার