এসএমই নীতিমালা: একটি ভালো পদক্ষেপ

:: প্রকাশ: ২০১৯-০৯-১৮ ১৩:০৫:৪৪


গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় জাতীয় শিল্পনীতির আওতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) নীতিমালা ২০১৯-এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এতে স্টার্টআপ বা নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করা এবং নারী উদ্যোক্তাদের নতুন সুবিধা প্রদান করাসহ এসএমই খাতে বিভিন্ন রকম নতুন সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে।

অর্থমন্ত্রী তার ২০১৯-২০ সালের বাজেট বক্তৃতায় যুবকদের মধ্যে সব ধরনের ব্যবসা উদ্যোগ (স্টার্টআপ) সৃষ্টির জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের যে প্রস্তাব রাখেন, তারই ফলস্বরূপ এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মনে হয়।

দেশে যখন বিনিয়োগঘন (ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ) শিল্পকারখানা স্থাপনে রয়েছে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার যখন অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে, দারিদ্র্য হার হ্রাসে যখন নিুগতি দেখা দিয়েছে, তখন সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এ ধরনের উদ্যোগ শুধু জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান বাড়াবে না, বরং দেশে বেকারত্ব হ্রাসে এবং দারিদ্র্য হার হ্রাসের নিুমুখী গতি রোধে সহায়ক হবে।

মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, নতুন নীতিমালায় মূলত ছয়টি বিষয়কে সামনে রাখা হয়েছে। এগুলো হল- ১. বিনিয়োগকারীর অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ, ২. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ, ৩. বাজারে প্রবেশের সুযোগ, ৪. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ, ৫. ব্যবসায়ে সহায়তা প্রদান (এক্সেস টু বিজনেস সাপোর্ট সার্ভিসেস), ৬. তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ। নীতিমালায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে মাইক্রো বা অতি ক্ষুদ্র শিল্পকেও যুক্ত করা হয়েছে বলে তিনি জানান। নীতিমালায় আর যেসব নতুন বিষয় আছে বলে তিনি জানান, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক. বাস্তবায়ন কৌশলের আওতায় কৌশলগত এসএমইর অর্থপ্রাপ্তিতে এর সুযোগ বৃদ্ধি করা। খ. এসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। গ. এসএমই ক্রেডিট গ্যারান্টি ফান্ড চালু করা, যার ফলে মর্টগেজের ব্যবস্থা থাকবে না। ঘ. স্টার্টআপ বা নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করার ক্ষেত্রে সহায়তা করা। ঙ. তথ্যপ্রযুক্তি যেমন- ই-কমার্স, অনলাইন সাপোর্ট, আউটসোর্সিং ও আইটিভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে এসএমইদের সহায়তা দেয়া। চ. নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ছয় ধরনের বিশেষ সুবিধা প্রদান এবং এগুলো হল- নারী উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; তাদের ঋণ দেয়া; তাদের জন্য তহবিল গঠন; তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; তাদের উদ্বুদ্ধ করা; তাদের কাজের জন্য বাজার সংযোগের সুযোগ বৃদ্ধি করা। ছ. ফরোয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের ব্যবস্থা রাখা। জ. পরিবেশবান্ধব শিল্প প্রতিষ্ঠায় এসএমইদের উৎসাহিত করা, শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দেয়া। ঝ. নীতি বাস্তবায়নে দুটি পর্ষদ গঠন করা, যার একটির নেতৃত্বে থাকবেন শিল্পমন্ত্রী এবং অন্যটিতে নেতৃত্ব দেবেন শিল্প সচিব।

বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত, কৃষিনির্ভর, ঘনবসতিসম্পন্ন ও গ্রামপ্রধান দেশ। এখানে বিনিয়োগঘন শিল্পকারখানা স্থাপনে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তাই এখানে বড় শিল্পকারখানা স্থাপনের পাশাপাশি গুরুত্ব দিতে হবে শ্রমঘন মাঝারি, ক্ষুদ্র এবং অতি ক্ষুদ্র শিল্প (এসএমই) স্থাপনে।

এসএমই একটি শ্রমঘন খাত এবং এর উৎপাদনকাল বৃহৎ শিল্প খাতের তুলনায় কম হওয়ায় এটি জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দ্রুত অবদান রাখতে সক্ষম। তাছাড়া দরিদ্র, বিশেষ করে, হতদরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা হ্রাসে এবং কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা আনয়নে ও নারীর ক্ষমতায়নে এ খাতটি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

বেকারত্ব দেশের একটি বড় সমস্যা। দেশের উচ্চ দারিদ্র্য হারের জন্য বেকারত্বের উচ্চ হার অনেকটা দায়ী। কারণ বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এসএমই খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দ্রুত অবদান রাখতে সক্ষম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ মোতাবেক, দেশের মোট ১৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯০ লাখ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এখানে আর যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হল, কর্মক্ষম শ্রমশক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ যুবকদের (এখানে যুবক বলতে যুবতীদেরও বোঝাবে) সংখ্যার আধিক্য।

জরিপ অনুযায়ী মোট কর্মক্ষম শ্রমশক্তির ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ যুবক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। গত বছরের ১৬ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের কর্মসংস্থান নিয়ে ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ২০১০ সালের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে ৪ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা বিবিএসের ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের হারের (৪ দশমিক ২ শতাংশ) চেয়ে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

আর যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব ২০১০ সালের ৬ দশমিক ৪ শতাংশের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর যে বিষয়টি ভাবনার উদ্রেক করেছে তা হল- শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হারের উল্লম্ফন। জরিপ অনুযায়ী প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্পন্নকারী শিক্ষিত যুব বেকারের হার যথাক্রমে ২ দশমিক ৭, ৪ দশমিক ৬, ১৪ দশমিক ৯ এবং ১১ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্পন্নকারী শিক্ষিত যুবকদের বেকারত্বের হার জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হারের তিন গুণ বা তার বেশি। শিক্ষিত যুব বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য চিহ্নিত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- এক. শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য।

বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত যুবক প্রতিবছর শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। দুই. শ্রমবাজারের চাহিদা ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ফারাক। শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার বহুলাংশে মিল না থাকায় বাড়ছে শিক্ষিত যুব বেকারের সংখ্যা। তিন. দেশের বেশিরভাগ শিক্ষিত যুবক নিজস্ব ব্যবসা বা আত্মকর্মসংস্থানে আত্মবিশ্বাসী নয়।

তারা কোনোরকম একটি চাকরি নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনে আগ্রহী। অবশ্য দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা তাদের আত্মকর্মসংস্থানে উদ্যোগী হতে সাহস জোগায় না। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- নিজস্ব তহবিলের অভাব, ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নীতিমালা উদ্যোক্তাবান্ধব না হওয়া এবং প্রশাসনিক জটিলতা। সহজ শর্তে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের ঋণ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদানের যে প্রস্তাব এসএমই নীতিমালা ২০১৯-এ রয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন দেশে শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার হ্রাসে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

আন্তঃবিভাগীয় দারিদ্র্যবৈষম্য নিরসনে এসএমই নীতিমালা ২০১৯-কে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিবিএসের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০১৬ মোতাবেক দেশের আটটি প্রশাসনিক বিভাগের মধ্যে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগে। এখানে দারিদ্র্যের হার ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হারের প্রায় দ্বিগুণ।

দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ ১০ জেলার পাঁচটিই রংপুর বিভাগে। সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত বিভাগ বা অঞ্চলগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগ। ময়মনসিংহ বিভাগে দারিদ্র্যের হার ৩২.৮ শতাংশ।

রাজশাহী বিভাগে দারিদ্র্যের হার ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ। খুলনা ও বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৫ এবং ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে দারিদ্র্যের হার জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হারের নিচে। ঢাকা বিভাগে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম। এখানে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক শূন্য শতাংশ। সিলেট বিভাগে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

দরিদ্রতম রংপুর বিভাগ যুগ যুগ ধরে শিল্প খাতে রয়ে গেছে অনুন্নত। ইংরেজ আমলের কথা বাদ দিলেও পাকিস্তান আমলে শিল্প খাতে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, তা ছিল ভারি শিল্প খাতে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা এবং দুটি বড় সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলার সঙ্গে যোগাযোগ সহজগম্য না থাকায় সঙ্গত কারণে এ এলাকায় বৃহৎ শিল্পের প্রসার ঘটেনি। বাংলাদেশ আমলেও এখানে বড় বা মাঝারি ধরনের শিল্পের তেমন প্রসার ঘটেনি। অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের অভাব ইত্যাদি কারণে শিল্পোদ্যোক্তারা এখানে বড় ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসছেন না।

বিশেষ করে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় গ্যাসভিত্তিক ইউরিয়া সার কারখানা, সিরামিক শিল্প, ওষুধ শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্প, অটো অ্যাসেম্বলি শিল্প ইত্যাদি গড়ে উঠতে পারছে না। বিবিএসের ইকোনমিক সেন্সাস ২০১৩ মোতাবেক যখন ঢাকা বিভাগে ইকোনমিক ইউনিটের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯৯ হাজার, তখন রংপুর বিভাগে এ সংখ্যা ১০ লাখ ৮৮ হাজার।

ইকোনমিক ইউনিট এমন একটি একক প্রতিষ্ঠান বা ইকোনমিক হাউসহোল্ড (খানা), যা হাউসহোল্ড আয় বৃদ্ধি বা কমিউনিটির পরোক্ষ সুবিধার জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। যে বিভাগে ইকোনমিক ইউনিটের সংখ্যা যত বেশি, সে বিভাগে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য তত বেশি।

সবশেষে বলতে চাই, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে এসএমই নীতিমালা ২০১৯ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হোক। দেশের শিল্পায়নের অগ্রগতিতে এ নীতিমালা অবদান রাখুক। দেশে আন্তঃবিভাগীয় দারিদ্র্যবৈষম্য নিরসনে এ নীতিমালা এগিয়ে আসুক।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com