বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পেঁয়াজের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছিল গত মঙ্গলবার। তবে দেখা গেছে তাদের ঘোষণার পর উল্টো পেঁয়াজের দাম বাড়ছেই। চট্টগ্রামের পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জে গতকাল শুক্রবার মৌসুমের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। পাইকারি এ মোকামেই দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা কেজি। আর ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায়। খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকা ও ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। অথচ বৃহস্পতিবারও টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমার থেকে এসেছে ৪৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ। আর পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক ছিল সাতটি। এসব ট্রাকে প্রায় ৯০ টন পেঁয়াজ ছিল। সেখানকার আমদানিকারকরা বলছেন, গত ছয় দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারি মোকামে প্রায় ৪০০ টন পেঁয়াজ পাঠিয়েছেন তারা।
কিন্তু খাতুনগঞ্জে গত চার দিনে টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের পেঁয়াজ নিয়ে মাত্র আটটি ট্রাক এসেছে চট্টগ্রামে। বৃহস্পতিবার রাতে ভারত থেকেও এসেছে ৮ ট্রাক পেঁয়াজ। প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমার থেকে স্মরণকালের সর্বোচ্চ পেঁয়াজ আমদানির পরও খাতুনগঞ্জে আসেনি পর্যাপ্ত পেঁয়াজ। কেন এমনটি হচ্ছে? আর মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর ভারতের পেঁয়াজের সরবরাহ কেন আরও কমে গেল?
ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী সংস্থা ক্যাব মনে করছে, পেঁয়াজ কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেভাবে কাজ করেনি। তাই তাদের ঘোষণার পর উল্টো দাম বেড়েছে। এ ব্যাপারে ক্যাবের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, 'মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর সিন্ডিকেট করে কিছু ব্যবসায়ী সরবরাহ আরও কমিয়ে দেওয়ায় দাম অরও বেড়েছে। বাজার অস্থির রাখতে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজও টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামের পাইকারি মোকামে আনতে দেয়নি তারা। যারা এ কারসাজির সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।'
খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের পাইকারি মোকাম হচ্ছে হামিদ উল্লাহ মিয়া মার্কেটে। এ মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া বলেন, 'বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনো প্রস্তুতি ছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পেঁয়াজের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছিল। এতে করে বাজারে আরও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ঘোষণার পর খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের সরবরাহ আরও কমে গেছে। মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের পেঁয়াজ নিয়ে আটটি ট্রাক এসেছে। অথচ রোববার ও সোমবার ১৫ ট্রাক পেঁয়াজ এসেছিল খাতুনগঞ্জে। ভারতের পেঁয়াজও আসছে চাহিদার অনেক কম। মঙ্গলবার ও বুধবার ভারতের পেঁয়াজ নিয়ে ১৫টি ট্রাক এসেছে এখানে। অথচ এর আগের দু'দিন আমদানি করা পেঁয়াজের অন্তত ২২টি ট্রাক এসেছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রামের পাইকারি মোকামে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১০ থেকে ১২ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি হয়েছে।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রবি ও সোমবার খাতুনগঞ্জে ২০ থেকে ২২টি ট্রাকে ভারত ও মিয়ানমারের অন্তত ৩০০ টন পেঁয়াজ আসে। কিন্তু মঙ্গল ও বুধবার মিয়ানমারের কোনো পেঁয়াজ আসেনি। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় মঙ্গলবারের পর থেকে আবার বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম।
খাতুনগঞ্জে রবি ও সোমবার সাউথ নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকায়। মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর থেকে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। মঙ্গল ও বুধবার দাম আরও বেড়ে পাইকারি মোকামে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয় পেঁয়াজ। বৃহস্পতিবার আরও এক দফা বেড়ে পেঁয়াজের দাম ছাড়িয়ে যায় ৬০ এর ঘর। শুক্রবার ভারতের নাসিক পুরনো পেঁয়াজ ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা ও সাউথ পুরনো পেঁয়াজ ৭০ টাকায় বেচাকেনা হয়। খুচরা বাজারে একই পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে দর বেশ বৃদ্ধি পায়। ফলে ভারত সরকার পেঁয়াজের নূ্যনতম রফতানি মূল্য টনপ্রতি ৮৫০ ডলার নির্ধারণ করে। আগে যেখানে ২৫০ থেকে ৩০০ ডলারে আমদানি করা যেত তা ৮৫০ ডলারে ওঠায় দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। তবে তারা স্বীকার করছেন, মিয়ানমারের পেঁয়াজ ঠিকঠাকভাবে চট্টগ্রামের মোকামে এলে অন্তত এ অঞ্চলের আশপাশে নিয়ন্ত্রণে থাকত পেঁয়াজের দাম।
টেকনাফ স্থলবন্দরের কাস্টমস সুপার আবছার উদ্দিন বলেন, 'পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক করতে আমদানিকারকদের মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আনতে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাদের পণ্য দিনে দিনে খালাসের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালেও ৪৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ মিয়ানমার থেকে এসেছে। এর আগের চার দিনে আরও অন্তত ৪০০ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এসব পেঁয়াজ বাজারে গেলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়ার কথা।'
সরেজমিন দেখা যায়, পেঁয়াজভর্তি সাতটি ট্রাক টেকনাফ স্থলবন্দরে সারিবদ্ধভাবে ছিল। সেগুলো বিকেলে চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চট্টগ্রামের মোকামে আসেনি কোনো পেঁয়াজভর্তি ট্রাক। অথচ টেকনাফ শুল্ক্ক বিভাগ জানায়, মিয়ানমার থেকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ১৭৮ দশমিক ১৮০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসে। এর পরের দিন আসে ৪ দশমিক ৯৪৫ মেট্রিক টন। ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর আসে ১৩৩ ও ১৮০ টন পেঁয়াজ। আর ১৯ সেপ্টেম্বর আসে ৪৩ টন পেঁয়াজ। আমদানি করা এসব পেঁয়াজও যথাযথভাবে পৌঁছেনি খাতুনগঞ্জের বাজারে।
অথচ গত মঙ্গলবার ঢাকায় বৈঠক করে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন এবং বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য আবু রায়হান আল বিরুনি ঘোষণা দেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পেঁয়াজের দাম কমবে। তারা আরও জানান, পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন এবং সুদের হার হ্রাসের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে পত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এ ঘোষণার পর উল্টো হু হু করে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।