ব্যাংকের সুদ ও রিবা কি এক জিনিস?
:: আপডেট: ২০১৯-০৯-২২ ১৩:০২:৩৮
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, অর্থনীতির জন্য স্থিতিশীল ও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তক ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থাকে আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘ফ্রড’ বলে উল্লেখ করেছেন। পত্র-পত্রিকায় দেখলাম তিনি জাতীয় সংসদে হাবিবুর রহমান মোল্লার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘ইসলামী ব্যাংকিং প্রথম থেকেই আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা একান্তই একটা ফ্রড এবং সেভাবেই এটাকে সবসময় বিবেচনা করেছি।… তিনি আরো বলেন, ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। রিবা এবং বর্তমান সুদ এক জিনিস নয়। রিবা চক্রবৃদ্ধি সুদ। রিবার মধ্যে কোনো ধরনের মানবিক চিন্তাধারা নেই। কিন্তু সুদ মানবিক চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুদ হলো কস্ট অব ফান্ড এবং কস্ট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। কিন্তু রিবাতে সেটা ছিল না। যারা ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলেন তারা সুদ ও রিবাকে এক করে ফেলেন। এটা একান্তই ভুল এবং এই ভুলের ওপর ভিত্তি করেই ইসলামিক ব্যাংকিং হয়েছে।’ তার এ বক্তব্য থেকে তিনটি বিষয় উঠে আসে। এগুলো হলো, ক. ইসলামী ব্যাংকিং কি ফ্রড, খ. আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ কি একই জিনিস ও গ. সুদ কি মানবিক চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত?
ক. ইসলামী ব্যাংকিং কি ফ্রড?
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গৌরব আবুল মাল আবদুল মুহিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন অর্থনীতিবিদ ও দেশের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ। আমি তার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, তার উক্ত অভিমত আমার কাছে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়নি। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক কি কারণে ফ্রড তা তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট নয়। যদি ধরে নেয়া হয় তার এ মন্তব্যের অর্থ হলো, ইসলামী ব্যাংকের হিসাব-নিকাশ স্বচ্ছ নয়। তাহলে আমরা বাস্তবে দেখি এর উল্টো অবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রুলস-রেগুলেসন্স, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং স্ট্যান্ডার্ড-ব্যাসেল-২ ও মানি লন্ডারিং আইনসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন-কানুন পরিপালনে ব্যাংদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক থেকে এগিয়ে রয়েছে।
এ ছাড়া দেশের বহু সুদী ব্যাংক যখন ঋণদানে অনিয়ম ও দুর্র্নীতি করে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে তখন ইসলামী ব্যাংকগুলো এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবদান খ্যাতিমান সকলের কাছেই স্বীকৃত। অন্য দিকে ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদের বিকল্প হিসেবে লাভ-লোকসানে অংশীদারি পদ্ধতি, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা বা ভাড়া ইত্যাদি শরীআহ্সম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করে। তারা কোনোভাবেই ইসলামের নামে সুদের ব্যবসা করে না। তাই এক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকিংকে ‘ফ্রড’ বলা সমীচীন নয় বলেই মনে হয়।
খ. আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ কি একই জিনিস?
মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আরো একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে তা হলো, আল কুরআনের রিবা আর প্রচলিত ব্যাংকিং সুদ এক নয়। সম্ভবত তিনি আল কুরআনে উল্লেখিত রিবাকে নিষিদ্ধ বললেও ব্যাংকিং সুদকে বৈধ মনে করেন এবং ব্যাংকিং সুদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলেই তার ধারণা। প্রকৃতপক্ষে আল কুরআনের রিবা এবং ব্যাংকিং সুদ একই জিনিস এবং উভয়ই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
‘সুদ’ একটি উর্দু শব্দ, পবিত্র কুরআনে যা ‘রিবা’ শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় রিবার অর্থপ্রকাশক উপযুক্ত প্রতিশব্দ না থাকায় এর অনুবাদ করা হয় ‘সুদ’ শব্দ দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে রিবা শব্দটি আরো ব্যাপক অর্থবোধক। আর প্রচলিত সুদ সেই ব্যাপক অর্থের একটি অংশ মাত্র। সুদকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউজারি (usury) বা ইন্টারেস্ট (interest)।
আল কুরআনে ব্যবহৃত ‘রিবা’ পরিভাষাটি আরবি শব্দমূল ‘রাবউন’ থেকে উদ্ভুত। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, তাই রিবা বা সুদ। আবার একই শ্রেণিভুক্ত পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের সময় চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যে পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করা হয়, তাকেও রিবা বা সুদ বলা হয়। সুদ প্রধানত দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হলো রিবা আন নাসিআহ বা মেয়াদি সুদ। আরবি ‘নাসিআহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মেয়াদ, সময় নেয়া, বিলম্ব বা প্রতীক্ষা।
রিবা নাসিআহ হচ্ছে ঋণের ওপর সময়ের অনুপাতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ। যেমন কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে যে, তাকে মেয়াদান্তে ১১০ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১০ টাকাকে রিবা বলা হবে। আল কুরআনে উল্লেখিত এ রিবাকেই রিবা আন নাসিআহ বা রিবা আল কুরআন বলা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার রিবা হলো, রিবা আল ফদল। আরবি ‘ফদল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিস লেনদেনে কমবেশি করে আদায় করার নাম রিবা আল ফদল। অর্থাৎ, একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে একপক্ষ আরেক পক্ষের নিকট থেকে চুক্তি মোতাবেক শরীআহ্সম্মত বিনিময় ব্যতীত যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে তাকে রিবা আল ফদল বলে। যেমন, এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সাথে দেড় কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা। রিবা আল ফদলকে মালের সুদও বলা হয়।আল কুরআনে রিবাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আর হাদিসে সুদের
বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রাথমিক যুগের মুফাস্সিরগণ রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন। প্রখ্যাত মুফাস্সির জারির ইবন আত-তাবারি মুজাহিদের সূত্রে জাহেলি যুগে প্রচলিত রিবা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণিত হাদিস উল্লেখ করেছেন, ‘জাহিলি যুগে কোনো ব্যক্তি ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত। অতঃপর সে ঋণদাতাকে বলত, আমি এতো এতো পরিমাণ বেশি দেবো, আমাকে সময় বাড়িয়ে দাও।’
এ ছাড়া হাদিসে রিবা বা সুদের সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছে, ‘যে ঋণ মুনাফা টেনে আনে তাই রিবা বা সুদ।’ হাদিসে আরো বলা হয়েছে, ‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ আদান-প্রদান করলে, তা সমান সমান ও হাতে হাতে হতে হবে। অর্থাৎ নগদ হতে হবে। বেশ-কম করলে বা বাকিতে করলে, তা সুদী কারবার বলে গণ্য হবে। এতে দাতা-গ্রহীতা সমান অপরাধী হবে।’
ইমাম আবু বকর আল জাস্সাস তার বিখ্যাত তাফসির আহকামুল কুরআনে রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন : ‘জাহিলিয়াতের সময় সুদ ছিল, কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রদত্ত ঋণের আসলের উপর ঋণগ্রহীতা কর্তৃক দেয় নির্ধারিত অতিরিক্ত।’ ইমাম ফখরউদ্দিন আল রাজি জাহিলি যুগের রিবা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জাহিলিয়াতের যুগে রিবা আন-নাসিয়া ছিল সুপরিচিত ও স্বীকৃত। সে সময় তারা অর্থ ঋণ দিত এবং মাসিক ভিত্তিতে একটা অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় করত, কিন্তু আসল ঠিক থাকত। অতঃপর মেয়াদ শেষে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছে আসল অঙ্ক ফেরত চাইত। ঋণগ্রহীতা আসল অঙ্ক ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিত এবং মেয়াদ বাড়িয়ে দিত।’
ওপরে রিবার যে সংজ্ঞা পেশ করা হয়েছে তার সাথে বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংক সুদের কোনো পার্থক্য নেই। কেউ কেউ বলেন যে, পবিত্র কুরআনে কেবল ভোগ্যঋণের সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিন্তু বাণিজ্যিক ঋণের সুদ নিষিদ্ধ নয়। তারা যুক্তি দিয়ে বলেন, বাণিজ্যিক ঋণ নেয় ধনীরা এবং এ ঋণ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। তাই ভোগ্যঋণ দিয়ে সুদ আদায়ের ক্ষেত্রে যে বে-ইনসাফী ও অমানবিকতা রয়েছে তা উৎপাদনশীল বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে নেই। সুতরাং বাণিজ্যিক সুদ ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। তাদের এ বক্তব্য মোটেও সঠিক নয়। কেননা, পবিত্র কুরআনে সুদ সম্পর্কে যে সমস্ত আয়াত এসেছে সেখানে সুদের কোনো শ্রেণিবিভাগ করা হয়নি। ফলে সকল ধরনের সুদই হারাম।
ব্যাংকিং সুদ, ভোগ্যঋণের সুদ ও বিনিয়োগ সুদ বা ব্যবসার জন্য গৃহীত ঋণের সুদের মধ্যে পার্থক্য করার বিষয়টি একটি নতুন ধারণা। এ ধারণার প্রবর্তকদের মতে, শুধু ভোগ্যঋণের সুদ হারাম আর ব্যাংকিং সুদ বা বিনিয়োগ সুদ হালাল। তাদের এ ধারণা উম্মাহ্র সকল আলিম ও ফকিহ্দের মতামত থেকে ভিন্ন। তাদের মতের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ্র সমর্থন নেই। কেননা, মহান আল্লাহ সব ধরনের সুদ হারাম করেছেন। এ ব্যাপারে পবিত্র আল কুরআনের চূড়ান্ত ঘোষণা, ‘আল্লাহ্ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’
ব্যাংকিং সুদ বৈধ করার প্রবক্তাগণ বলেন যে, রাসূল (স.)-এর যুগে ব্যাংক ছিল না, এটি খৃস্টীয় ১৭ শতকের উদ্ভাবন-তাদের এ ধারণা ঐতিহাসিক গবেষণার মাধ্যমে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ের বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা থেকে জানা যায় যে, খৃস্টের জন্মের ২০০০ বছর পূর্বেও ব্যাংকিং লেনদেন চালু ছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া বৃটানিকা থেকে ব্যাংকব্যবস্থার গোড়ার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে, ‘‘ব্যাবিলনবাসীরা খৃস্টপূর্ব ২০০০ অব্দেই ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তবে এর পেছনে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত ও বিপুল সম্পদের অধিকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের আনুষঙ্গিক কাজ হিসেবেই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল।
খৃস্টপূর্ব ৫৭৫ অব্দ পর্যন্ত ব্যাবিলনে ‘দি ইজিবি ব্যাংক অব ব্যাবিলন’ নামে একটি ব্যাংক ছিল।’’ এই ব্যাংকের রেকর্ডপত্র থেকে জানা যায়, ব্যাংকটি গ্রাহকদের ক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করত, ফসলের উপর ঋণ দিত এবং ঋণের নিশ্চয়তাস্বরূপ ক্ষেতের ফসল জামানত হিসেবে গ্রহণ করত। এ ছাড়াও ব্যাংকটি ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে মূল্যবান জিনিস জামানত হিসেবে জমা রেখে ঋণ দিত এবং সুদের বিনিময়ে আমানত গ্রহণ করত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের অতি নিকটবর্তী সময়েও বাইজেন্টাইন সম্রাট শাসিত সিরিয়ায় সকল ধরনের শিল্প-বাণিজ্য ও কৃষিখাতে সুদভিত্তিক ঋণের প্রচলন ছিল।
সে সময় সুদভিত্তিক ঋণের এতই ব্যাপকতা ছিল যে, সম্রাটকে সুদের হার নির্ধারণপূর্বক আইন জারি করতে হতো। সে সময় সিরিয়ার সাথে আরববাসী, বিশেষ করে মক্কার অধিবাসীদের সুদীর্ঘ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এ বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে আরববাসীরাও বাণিজ্যিক সুদ সম্পর্কে ছিল পূর্ণ সচেতন। এ ছাড়া তৎকালীন আরববাসীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরন থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, সে সময় যেমন ভোগ্যঋণের প্রচলন ছিল, তেমনই বাণিজ্যিক ঋণেরও প্রচলন ছিল। ড. জাওয়াদ আলী জাহিলি যুগের আরবদের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, ‘সে সময় সকলে মিলে মুনাফার আশায় বাণিজ্য কাফেলাকে ঋণ দিত।’
ইবন জারির আত-তাবারি লিখেছেন, বনু ‘আমর গোত্র বনু আল-মুগিরা গোত্রের নিকট থেকে সুদ আদায় করত। ইমাম বুখারি একটি হাদিসে উল্লেখ করেছেন। সেখানে দেখা যায় যে, এক ইসরাইলি অন্য এক ব্যক্তির নিকট থেকে ১০০০ দিরহাম ঋণ নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বের হয়েছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ ঋণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় যেমন প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক ঋণের প্রচলন ছিল, তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও বাণিজ্যিক ঋণের প্রচলন ছিল।
এ বিষয়ে কুরআন-হাদিস ও ইতিহাসে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। ফলে কুরআন নাযিলের সমসাময়িককালে আরববাসীদের কাছে বাণিজ্যিক সুদের ধারণা সুস্পষ্ট ছিল। তাই এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই যে, কুরআন যে সুদ নিষিদ্ধ করেছে তা কেবল ভোগ্যঋণের সুদ, বাণিজ্যিক বা ব্যাংকিং সুদ নয়। প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার সুদই ইসলামে নিষিদ্ধ। শুধু ইসলাম নয়; বরং হিন্দু, খৃস্টান, ইহুদি, বৌদ্ধসহ বহু ধর্মেই সুদ নিষিদ্ধ। এমনকি বহু দার্শনিক যেমন প্লেটো, এ্যরিস্টটল, থমাস একুইনা ও মিসাব্যুর মতো দার্শনিকগণ সুদকে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
গ. সুদ কি মানবিক চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত?
সুদ মানবিক চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং এটির জন্মই হয়েছে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। এটির অপকারিতা শুধু ধর্মেই বর্ণিত হয়নি; বরং আধুনিক অর্থনীতিবিদগণের দৃষ্টিতেও সুদের কোনো শুভ ফল নেই। অর্থনৈতিক মন্দা, আয়বৈষম্য ও বেকারত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে সুদের প্রভাব স্পষ্ট। এক্ষেত্রে লর্ড কিনসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ কমে যায় এবং সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বেড়ে যায়। তিনি দেখিয়েছেন যে, সুদের হার শূন্য হলেই কেবল পূর্ণ বিনিয়োগ সম্ভব হয় এবং দেশের বস্তুগত ও মানবীয় সম্পদের কাম্য ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এ ছাড়াও সুদের আর্থ-সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপক। এ ক্ষুদ্র পরিসরে তা আলোচনা করার অবকাশ নেই।
পরিশেষে বলা যায়, আল কুরআনের রিবা ও প্রচলিত সুদ কোনোটির মধ্যেই মানবতার জন্য কোনো কল্যাণ নেই এবং উভয়ের অনিবার্য পরিণতি হলো অর্থনৈতিক মন্দা ও আর্থিক অস্থিতিশীলতা। এ থেকে বাঁচার জন্যই কল্যাণধর্মী ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার প্রসার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এটি কোনো নতুন ব্যাংকিং দর্শনও নয়; বরং ইসলামী ব্যাংকিং-এ জমাগ্রহণ নীতির ক্ষেত্রে বিশিষ্ট সাহাবি হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.)-এর দৃষ্টান্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বহু লোক তার কাছে অর্থকড়ি জমা রাখত এবং প্রয়োজনের সময় আংশিক বা সম্পূর্ণই ফেরত নিয়ে যেত।
তিনি জনসাধারণের অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ না করে করদ হিসেবে নিতেন। এ সম্পর্কে সহিহ আল বুখারিতে উল্লেখ রয়েছে যে, কেউ হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.)-এর কাছে অর্থকড়ি আমানত হিসেবে রাখার প্রস্তাব দিলে তিনি বলেন, ‘না, এভাবে নয়; বরং তুমি তা আমার কাছে ঋণ হিসেবে রেখে যাও।’ আব্বাসীয় খলিফা আল মুক্তাদিরের (৯০৮-৯৩২ খ্রি.) আমলে মুসলমানরা আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থার অধিকাংশ মৌলিক কর্মকান্ড শুরু করে। এ সময়ে তারা মুসলিম বিশ্বের সমস্ত সঞ্চিত অর্থকে একত্র করে মূলধন গঠনে সক্ষম হয়। দেশ-বিদেশে ব্যবসা পরিচালনায় সুদমুক্তভাবে অর্থ যোগান দিতেও সক্ষম হয়।
এ প্রক্রিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলতে থাকে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে নানাবিধ রাজনৈতিক কারণে মুসলমানরা তাদের অর্থনৈতিক নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলে। এ সময় পশ্চিমা শক্তি মুসলিম বিশ্বের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফলতা লাভ করেছে। এই মানবদরদি, কল্যাণধর্মী ও সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার উন্নয়নে দরদি মনোভাব নিয়ে সকলের এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক : একজন ইসলামী শরীআহ্ গবেষক
rahmatullah1066@ gmail.com
সানবিডি/ঢাকা/এসএস