মোকাম থেকে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক। এরপরও সারা দেশে বেসামাল পেঁয়াজের বাজার। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুরনো সেই শক্তিশালী কারসাজি চক্রই (সিন্ডিকেট) এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
চক্রের সদস্যরা কারসাজি করে ২০ দিনে চার ধাপে ভোক্তার পকেট থেকে কেটে নিয়েছে ন্যূনতম ৫৭২ কোটি টাকা। ভোক্তারা বলছেন, সরকার ক্যাসিনো কারবারিদের ধরছে। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি যে বা যারা নষ্ট করছে, তাদের ধরার কেউ নেই।
১২ সেপ্টেম্বর দেশের বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৫০-৫৫ টাকা কেজি। পরদিন ভারত পেঁয়াজের রফতানি মূল্য বাড়িয়ে ৮৫২ ডলার করে। এ খবরে সেদিন দেশের বাজারে ২৫-৩০ টাকা বাড়িয়ে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৮০ টাকা। এই দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয় ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা থাকে ২৪ লাখ টন। সে হিসাবে এক মাসের চাহিদা ২ লাখ টন। এক দিনে চাহিদা ৬ হাজার ৬৬৬ টন। এ হিসাবে এক দিনে ৩০ টাকা বাড়ানো হলে ১১ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে কাটা হয়েছে ২১৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
২৪ সেপ্টেম্বর সংকটের কথা জানিয়ে নতুন করে ৫ টাকা বাড়িয়ে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৮৫ টাকায়। যা দু’দিন বিক্রি হয়। এ দু’দিনে ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত ৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে ৯০ টাকা বিক্রি শুরু করে সিন্ডিকেট। ২৯ সেপ্টেম্বর বিকাল পর্যন্ত ওই দরে বিক্রি করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক বিক্রির হিসাব অনুযায়ী এ সময়ে প্রায় ২৬ হাজার ৫০০ টন পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ওই দরে। এতে ভোক্তার পকেট থেকে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে ১০৬ কোটি টাকা।
ভারত থেকে আমদানি বন্ধের অজুহাতে ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এক লাফে পেঁয়াজের দাম ৩০-৩৫ টাকা বাড়িয়ে ১২০-১২৫ টাকা বিক্রি করা হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত সেটি অব্যাহত ছিল। আরও দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এ সময়ে ভোক্তারা সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ কিনেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময়ে দৈনিক গড়ে প্রায় ৮ হাজার টন পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনে এতে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত কেটে নেয়া হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ চার ধাপে ভোক্তার পকেট থেকে ন্যূনতম ৫৭২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নিত্যপণ্যটির দাম যেভাবে বাড়ছে, তা স্বাভাবিক নয়। এটি এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তার মতে, পণ্যের দাম বাড়লে একজন আরেকজনের দোষ দেয়। তবে বিষয়টি নজরদারির দায়িত্ব সরকারের। কোনো ধরনের কারসাজি হলে তাদেরই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাজধানীর নয়াবাজারে মঙ্গলবার ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে ১২৫ টাকা কেজি দরে। আর মাঝারি মানের বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা। এ ছাড়া ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০০-১১০ টাকা কেজি।
বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা আসমা বেগম বলেন, পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। সরকার এখন ক্যাসিনো-সম্রাট ধরতে ব্যস্ত। কিন্তু বাজার সিন্ডিকেটদের ধরছে না। ক্যাসিনো কারবারিদের ধরলে গুটিকয়েক ব্যক্তির উপকার হবে। আর যদি বাজার সিন্ডিকেট ধরে তাহলে সারা দেশের মানুষের উপকার হবে। তিনি বলেন, এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি, পেঁয়াজ কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
শান্তিনগর কাঁচাবাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা মো. সুমন বলেন, বাজারে এসে এখন আর পেঁয়াজ কেনার উপায় নেই। দাম বাড়বে, তাই বলে এক লাফে ৪০ টাকা? তা দেখার জন্য দেশে কোনো কর্তৃপক্ষ বা সরকার কি নেই? তিনি বলেন, পণ্যের দাম বাড়ে কিন্তু বেতন বাড়ে না। এক দল অসৎ লোকের পকেট ভরে, আর আমরা সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়ি।
কারওয়ান বাজারের খুচরা বাজারে মঙ্গলবার দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজি দরে। ভারতীয় পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকা। খুচরা বিক্রেতা মো. সোনাই আলী বলেন, দাম বাড়ায় আমদানিকারকরা। যার প্রভাব পড়ে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। একই বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আবদুল মালিক বলেন, আমদানিকারকদের কারসাজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। তবে দেশে এখনও যে পরিমাণ পেঁয়াজ আছে তা দিয়ে নতুন পেঁয়াজ আসার আগ পর্যন্ত চলবে।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. আমানত আলী বলেন, আমরা কমিশনে বিক্রি করি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আমদানিকারকরা। তারা যে রেট (দর) দেয় সেই দামে আমাদের বিক্রি করতে হয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমদানিকারকদের প্রতি সরকারের নজর দিতে হবে। জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, পণ্যমূল্যের ওঠা-নামা বাজারের ধর্ম।
তবে দাম যখন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে তখন জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। তাই এটা দূর করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে চাহিদা নিরূপণ করে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। তারা একবার দাম বাড়ালে আর কমান না। তার মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো তেমন কার্যকর নেই। যার কারণে সিন্ডিকেট ধরা যাচ্ছে না।
বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বলেন, আমাদের কাছে যে হিসাব আছে, তাতে দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে বা যারা বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়িয়েছে, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা শুরু হয়েছে। আমরা কাউকেই ছাড় দেব না। বিভিন্ন জায়গায় অভিযান শুরু হয়েছে। তদারকি সেল (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়), ভোক্তা অধিদফতর ও বিভিন্ন সংস্থা বাজার তদারকি শুরু করেছে। কয়েক দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতায় চলে আসবে। জাফর উদ্দীন আরও বলেন, দেশে বর্তমানে কতটুকু মজুদ আছে তা জানতে ১০টি টিম কাজ করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। গত মৌসুমে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭ লাখ টন নষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ২২ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই মাস পর্যন্ত দেশে এক লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলছে, দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। সূত্র আরও বলছে, দুই সময়ে পেঁয়াজ বেশি আমদানি হয়। প্রথমত. দুই ঈদে, সে সময় পুরো আমদানির ৪০ শতাংশ আনা হয়। দ্বিতীয়ত. নভেম্বর-ডিসেম্বরে।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার মঙ্গলবার বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে। মঙ্গলবার মোহাম্মদপুর বাজারে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ৪ পেঁয়াজ বিক্রেতাকে ৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
সৈয়দপুরে কেজি ১২০ টাকা : সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, পাইকারি সবজি বাজার ঘুরে মাত্র ২-৪টি আড়তে পেঁয়াজ দেখা গেছে। সেখানে পাইকারি প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে খুচরা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০-১২০ টাকা।
মেসার্স বাঁধন ভাণ্ডার নামে এক আড়তের মালিক মো. কবিরুল ইসলাম কবির বলেন, বৃষ্টির কারণে আমদানি না হওয়া ও ভারতের রফতানি বন্ধের ঘোষণায় হঠাৎ পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বেড়েছে। সৈয়দপুর বণিক সমিতির সভাপতি মো. ইদ্রিস আলী বলেন, বাজার স্বাভাবিক রাখতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) পরিমল কুমার সরকার বলেন, মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সানবিডি/ঢাকা/যুগান্তর/এসএস