বাংলাদেশ ও ভারত বর্তমানে সর্বকালের সেরা সম্পর্ক উপভোগ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের তাদের নিজ নিজ জনগণের পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করে এই অঞ্চলটিকে আরও সমৃদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী ভারতের নয়াদিল্লিতে হোটেল আইটিসি মৌরিয়ায় আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের (আইবিবিএফ) উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণে একথা বলেন। খবর বাসসের
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের সকলকে প্লাটফর্মটির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে এবং আমাদের জনগণের বৃহত্তর পারস্পরিক স্বার্থে উভয় দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য অনুরোধ করছি এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশ ও এই অঞ্চলকে আরও সমৃদ্ধ এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারবো।’
আইবিবিএফের প্লাটফর্মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারত সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক উপভোগ করছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আপনাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্লাটফর্মটি রয়েছে এবং আমরা আপনাদের প্রচেষ্টা সহজ করার জন্য সকল ধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী ভারতের ব্যবসায়ীদের বংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কগুলোতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বেশ কয়েকটি হাইটেক পার্ক প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্যও প্রস্তুত রয়েছে। মংলা, ভেড়ামারা ও মিরেরসরাইয়ে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য তিনটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই তিনটি ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আমাদের রফতানিযোগ্য খাতকে আরও প্রশস্ত করতে সহায়তা করবে।’
‘আমরা সারাদেশে একশ’ বিশেষ অর্থনৈাতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছি, যার মধ্যে প্রায় ১২টি তৈরী হয়ে গেছে যেখানে ৪টি অঞ্চল ৩টি দেশের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে’, যোগ করেন তিনি।
এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থান দেশটিকে এই অঞ্চলের অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমে ভারত, উত্তর দিকে চীন এবং পূর্বদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বাংলাদেশ ৪ বিলিয়ন মানুষের বাজারের মাঝামাঝি রয়েছে।
বৈশ্বিক সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবৃদ্ধির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশে বৈশ্বিক এফডিআই’র ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থারই প্রতিফলন।
সংসদের প্রাসঙ্গিক আইন এবং দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির দ্বারা বিদেশি বিনিয়োগকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে আরো বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ দেখতে চাই যেখানে ভারতীয় বড় বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে শিল্প স্থাপন করতে এবং আমাদের মধ্যে বিদ্যমান উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানী করতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা জানি যে, বিশ্বের বেশিরভাগ বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলো তাদের প্রতিবেশী দেশগুলিতেই তাদের প্রাথমিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রকল্প গ্রহণ করেছে।’
একইভাবে ভারতীয় ব্যবসায়ী নেতারা আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আরও এগিয়ে নিতে খুব বড় ভূমিকা পালন করেতে পারেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বা ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে সক্ষম হব এবং এভাবেই আমরা আমাদের শহিদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারি, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ভারতীয় ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে দেশে সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ নীতি বলবৎ থাকার বিষয়টি পুণরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে উদার বিনিয়োগের পরিবেশ বিরাজ করছে। যার মধ্যে রয়েছে-বৈদেশিক বিনিয়োগের আইনী সুরক্ষা, উদার রাজস্ব ব্যবস্থা, মেশিনপত্র আমদানীর ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়, আনরেসট্রিকটেড এক্সিট পলিসি, সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ও পুঁজি নিয়ে চলে যাবার সুবিধাসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধা।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, সংসদের প্রাসঙ্গিক আইন এবং দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির দ্বারা ও বিদেশি বিনিয়োগকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বিশাল জনসংখ্যা, যাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ বছরের কম, যারা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক মজুরিতে নিযুক্ত হতে প্রস্তুতসহ বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘দ্রুত নগরায়নের ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্ভাবনার দিকেই ইঙ্গিত করে।’
সন্ত্রাস এবং দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ১৬২ মিলিয়ন জনসংখ্যা সমন্বিত একটি প্রগতিশীল ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। বাণিজ্যের ভারসাম্য যদিও এখন পর্যন্ত ভারতের পক্ষে রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে, বাংলাদেশে ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে ভারত এবং বাংলাদেশ এই দেশটির আটতম বৃহত্তম রপ্তানী গন্তব্য। ভারতে আমাদের রপ্তানীও গত বছরের প্রথমবারের মতো ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সুতরাং, অগ্রগতি দৃশ্যমান, তবে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্ক আরও গভীর করার অনেক সুযোগ রয়েছে। ’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ভারতের শিল্প ও রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল, বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী, ফেডাবেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-রসভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, ভারতের কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির (সিআইআই)-র সভাপতি বিক্রম শ্রীকান্ত কিরলসকার, ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি (এফআইসিসিআই)-র সভাপতি সন্দীপ সোমনি অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি অব ইন্ডিয়া (এএসএসওসিএইচএএম)-এর সভাপতি বালকৃষ্ণ গোয়েঙ্কা ।
অনুষ্ঠানে ‘প্রতিশ্রুতিশীল বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি ভিডিও উপস্থাপনা পরিবেশিত হয়।
অনুষ্ঠানে ভারতে শিল্প ও রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত এখন সবচেয়ে দৃঢ় সম্পর্ক উপভোগ করছে। তিনি সুসম্পর্কেও এই সুবিধা গ্রহণ করে দুই দেশের মানুষের উন্নতির জন্য অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য খাতকে আরও নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীযতার উপরও জোর দেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।