সারা দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলছে এবং অভিযানে বড় বড় দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ছে, এটা অত্যন্ত ভালো একটি উদ্যোগ। সরকারের এই উদ্যোগকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। যে বিষয়টি সবচেয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো—সরকারের নিজের দলের ভেতরেই এই অভিযান শুরু হয়েছে। অতীতে এমন অভিযান আর কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সেই হিসেবে এটাকে খুব বড় ধরনের কর্মপ্রচেষ্টা বলে মনে হয়।
তবে একটি কথা—সরকার যদি সত্যিই দেশ থেকে সমূলে দুর্নীতি দূর করতে চায়, সে জন্য কতগুলো বিষয়ে ভাবতে হবে। শুধু বড় বড় ক্যাসিনোতে অভিযান চালালে হবে না। এর জন্য দরকার পরিকল্পিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও দুর্নীতির বিষয়টি ফলাও করে বলা হয়েছিল।
দেশ থেকে সব ধরনের দুর্নীতি দূর করার বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এত দিনে এসে সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি। এতে আমাদের সুধীসমাজের মধ্যে একটা ভালো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কাজেই এই অভিযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভালো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এখানে আনন্দের খবর হচ্ছে, নিজের দলের ভেতর থেকে অভিযান শুরু হয়েছে। এটা খুবই ভালো বিবেচনা। এটাকে স্বাগত জানাই। দুর্নীতির বিষয়টি সারা দেশে এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে, কয়েকটি অভিযানে বা অল্প কয়েক দিনের ভাবনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।
ক্যাসিনো কাণ্ড নিয়ে যেভাবে সাঁড়াশি অভিযান চলছে সারা দেশে, সেভাবে টপ টু বটম—সব খাতেই হানা দিতে হবে। সরকারের কাছে সব খবরই আছে। কোথায় কত বড় ও ছোট ধরনের দুর্নীতি হয়, কারা জড়িত আছে এবং শাখা-প্রশাখা কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, এসব খবর সরকারের জানার বাইরে নয়।
এ জন্য বলছি যে দুর্নীতি সমূলে দূর করতে হলে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। বড় কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে শেষ করে দিলে কাজ হবে না। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে।
জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং যত গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালত আছে, সব জায়গায় হানা দিতে হবে। এটা যে ব্যাধি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা দূর করার জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই এ বিষয়ে বড় ধরনের সাফল্য আসবে।
দুর্নীতি কী বিপুলভাবে ছড়িয়ে গেছে, তার একটি বড় উদাহরণ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলরদের নামে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কাজে দুর্নীতির অভিযোগ। আমরা আমাদের সময়ে এ ধরনের অভিযোগের কথা কখনো শুনিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের কথা আগে শোনা যায়নি। এখন নিশ্চয়ই দুর্নীতি হচ্ছে। ফলে বিষয়গুলো অন্য অনেক বড় বিষয়ের মতো সামনে চলে আসছে।
সরকারের প্রধান অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ। তারাও অনেক ক্ষমতা রাখে, তা তো দেখাই যাচ্ছে। তারা এমন কোনো অনিয়ম নেই যে করছে না। অতীতেও ছাত্রসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ছিল। এসব বিষয়ে আগে কখনো বড় ধরনের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রয়োজনও হয়নি। কিন্তু বর্তমানে এই বিষয়গুলো এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরাসরি সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। এসব সুধীসমাজকে ভাবিয়ে তোলে।
আমি বাসায় ছয়-সাতটি দৈনিক পত্রিকা রাখি। দেশের কোথায় কী ঘটছে, কোথায় দুর্নীতি বা অনিয়ম হচ্ছে, দিনের শুরুতেই জানা হয়ে যায়। সরকারের বাইরে আওয়ামী লীগ ও তাদের যেসব অঙ্গসংগঠন আছে, তাদের মধ্যে কত ধরনের যে সমস্যা ও দুর্নীতি আছে, এগুলো কে জানত। জানার প্রয়োজনও হতো না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যে অভিযান চলছে, তার মাধ্যমে সব কিছু বেরিয়ে আসছে। ভাবা যায়—পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে সম্পদ বেড়েছে ছয় গুণ বা সাত গুণ। এসব নিয়ে কখনো সেভাবে তদন্ত বা অভিযান পরিচালিত হয়নি। এখন সরকারের স্বউদ্যোগে যে অভিযান চলছে, এর মাধ্যমে মানুষ জানতে পারছে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে তারা কত টাকা-পয়সা কামিয়েছে।
এমন জোরালো অভিযান অনেক আগেই দরকার ছিল। সেটা কোনো না কোনোভাবে ফসকে গেছে বা সম্ভব হয়নি। এত দিন পর যখন অভিযান শুরু হয়েছে, এটাকে থামিয়ে দেওয়া যাবে না। এটাকে চালিয়ে যেতে হবে। সরকারের দেশ পরিচালনার যতগুলো আন্তরিক মনোভাব আছে, এটা তার মধ্যে বড় একটি কাজ। কোনোভাবেই এই অভিযান বন্ধ হয়ে যাক, আমরা চাই না।
আর একটি বড় বিষয়—এখন অনেকেই রাজনীতি করতে আসে নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার আশায়। কখনো ব্যবসায় সুবিধা পাওয়ার জন্য বা বিশেষ ফায়দা পেতে রাজনীতিতে আসে। রাজনীতির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে, নানা ধরনের দুর্নীতি করে বড় কিছু করার চিন্তা থেকেও রাজনীতিতে আসে। এসব বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের নেতার আবির্ভাব ও বিস্তার যে শুধু আওয়ামী লীগের মধ্যে আছে, এমন নয়।
এটা সব সময়ই ছিল। এখন বেড়েছে। সরকারের কাজ হবে, ফায়দা লোটার জন্য কেউ যেন রাজনীতিতে আসতে না পারে সেটা বন্ধ করা ও নজরদারি জারি রাখা। এরা দেশের কল্যাণে নয়, শুধু নিজেদের আখের গোছানোর জন্যই রাজনীতিতে আসে। এমন নেতা দিয়ে তো কোনো লাভ নেই।
রাজনীতিতে আমরা এমন নেতা চাই, যাঁরা সৎ ও আদর্শবান। যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসেন এবং তাঁদের রাজনীতি দেশ ও দশের কল্যাণেই হবে। এই আশাবাদ আমরা রাখি সব সময়। সেটা যেকোনো দলের থেকেই রাজনীতিবিদ আসুন না কেন।
পৃথিবীর সব দেশেই দুর্নীতি আছে। আমাদের দেশে অনুপাতটা একটু বেশি। এটাকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। আবার এক দিনেই তা দূর করা সম্ভব হবে না। এ জন্য ভবিষ্যতে যেন ত্যাগী ও দেশপ্রেমী নেতা আসতে পারে, সরকারের সে বিষয়ে নজর থাকলে ভালো হয়। অভিযান চলছে, এভাবেই চলতে থাকুক। এই অভিযান যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এবং লোক-দেখানো পর্যায়ে গিয়ে থেমে না যায়। সার্বিকভাবে এই অভিযান চালিয়ে যেতে হবে।
এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দুর্নীতি। অনেক নেতা ও কর্মকর্তা হয়তো ভাবছেন, মন্ত্রী-এমপিরা দুর্নীতি করেন, আমার বস দুর্নীতি করেন, আমি করলে সমস্যা কী? কাজেই দুর্নীতি নিয়ে আমাদের শুভবোধের জায়গাটাও নষ্ট হয়ে গেছে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অনেক দিন ধরে জেলে আটক রয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছে, শরীরও ভালো নেই। বিএনপি তাঁকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নেত্রীর মুক্তির জন্য যে ধরনের প্রক্রিয়া দরকার, একটা বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি বা নিজেদের মধ্যেই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার—তা মনে হয় সম্ভব হয়নি। বিএনপির মধ্যেও এখন হয়তো দুটো ভাগ হয়েছে, নেত্রীর মুক্তির ব্যাপারে। সরকারেরও মানবিক বিবেচনা দরকার। তাঁর বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে যদি সহজ উপায়ে কিছু করা যায়।
পত্রিকায় দেখলাম এমাজউদ্দীন আহমদ সাহেব বলেছেন, যেহেতু এখন সব কিছু নিয়ন্ত্রিত; কাজেই সরকার চাইলে তাঁর মুক্তি নিয়ে ভালো কিছু করা যেতে পারে। আর তিনি মুক্ত হলেও দলের জন্য বিশেষ কিছু হবে, তা মনে হয় না। দীর্ঘদিন বিএনপি ক্ষমতায় নেই। দলের অবস্থাও এলোমেলো। ফলে নতুন করে তিনি দলের হাল ধরতে পারবেন, সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
এখন রাজনীতি কলুষতায় ভরে গেছে। সব দলেরই এক অবস্থা। দুদক যে এত কাজ করছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এত অভিযান পরিচালনা করছে, তাতে কি দেশ থেকে দুর্নীতি দূর হয়ে গেছে?
রাজনীতি এখন আর আগের মতো নেই। সরকারের বাইরে যারা আছে, তাদের অবস্থাও ভালো নয়। জাতীয় পার্টি তো সরকারেরই অংশ। ইসলামী শাসনতন্ত্র তো সেভাবে নেই। জামায়াতের পক্ষে কিছু করার তো প্রশ্নই ওঠে না। একমাত্র বিএনপিই বড় দল।
কিন্তু তারাও ১৩ বছর ক্ষমতার বাইরে। তবু বিএনপিকেই সব কাজে দোষী করা হয়। এই কাজের জন্য বিএনপি দায়ী, অমুক কাজের জন্য বিএনপি দায়ী। এসব মন্তব্যে অভিযান হালকা হয়ে যায়। আমি আপাতত রাজনীতি নিয়ে নতুন ও আশাজাগানিয়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
সানবিডি/ঢাকা/এসএস