নানা সীমাবদ্ধতা ও সংকটের মধ্যেও বিগত এক যুগে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক পণ্য তথা কনটেইনার হ্যান্ডলিং অন্তত চারগুণ বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয়ও। কমেছে জাহাজ ও কনটেইনারের গড় অবস্থান সময়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি অপারেটরদের হাতে হ্যান্ডলিং কার্যক্রম ছেড়ে দেয়া, বন্দরের টার্মিনাল ও জেটি বৃদ্ধিসহ নানা পদক্ষেপের কারণে এ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। এর স্বীকৃতি এসেছে বৈশ্বিক র্যাংকিংয়েও। তবে এত অর্জনের মধ্যেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এলে সৃষ্টি হয় জাহাজ ও কনটেইনার জটের। এতে দুর্ভোগ দুর্দশায় পড়তে হয় আমদানি ও রফতানিকারকদের।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীরাও এ অর্জনের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তারা বলছেন, যেভাবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাড়ছে তা সামাল দিতে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।
প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালে সবার আগে কনটেইনার ইয়ার্ড ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। এতে আমদানি কনটেইনার বন্দরের ভেতরে না রেখে বাইরে নিয়ে পণ্য খালাস করা যাবে। তখন বন্দরে কনটেইনার জট যেমন হবে না, তেমনি বহির্নোঙ্গরে জাহাজ জটও লাগবে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বশেষ বোর্ড সভায়ও বে-টার্মিনালে ট্রাক টার্মিনাল ও কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণকাজ কখন শুরু করা যাবে- সেই সিদ্ধান্ত জানাতে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০৬ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৮ লাখ ৭৬ হাজার ১৮৬ টিইইউএস (টুয়েন্টি ফিট ইক্যুভেলেন্ট ইউনিটস বা ২০ ফুট সমমান)। এক যুগ পর ২০১৮ সালে এসে তা প্রায় চারগুণ বেড়ে ৩০ লাখ টিইইউএসে উন্নীত হয়।
এ বছর কেবল টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডই কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে ১৫ লাখ ৬০ হাজার টিইইউএস। অর্থাৎ মোট হ্যান্ডলিংয়ের ৫৩ শতাংশই করে একটি অপারেটর। সিসিটি (চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল) ও এনসিটিতে (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল) তারা পণ্য হ্যান্ডলিং করছে।
জেনারেল কার্গো বার্থ অপারেটররা বাকি ৪৭ শতাংশ পণ্য বা কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান ছিল ১২ থেকে ১৩ দিন, কনটেইনারের গড় অবস্থান ছিল ২৫-২৬ দিন। ওই বছর গ্যান্টিক্রেনের মাধ্যমে অপারেশনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আয় করে ১৮ কোটি ৯৩ লাখ ৮২ হাজার ৭২০ টাকা।
এক যুগ পর অর্থাৎ ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থান নেমে আসে ২ দশমিক ৩ দিনে। কনটেইনারের গড় অবস্থান নামে ৮ থেকে ৯ দিনে। কেবল গ্যান্টিক্রেনের মাধ্যমে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে এ বছর বন্দরের রাজস্ব আয় হয় ৪৮ কোটি ৭৯ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮০ টাকা।
২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ খাতে চট্টগ্রাম বন্দরের গড় আয় হয়েছে প্রতি বছর ৪০ কোটি টাকা। অন্যান্য খাতের আয়ও বহুগুণ বেড়েছে। ২০০৯ সালে লয়েডসের জরিপে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিশ্বের ১০০ শীর্ষ বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৯৮তম।
২০১৯ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৬৪-তে । সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমাও বর্তমানে বেড়েছে। ৭ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল থেকে বেড়ে বন্দরের জলসীমা বর্তমানে ৫৪ নটিক্যাল মাইলে উন্নীত হয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ঘিরে যে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তা ঘিরেই এ জলসীমা ও বন্দরের সেবার পরিধি বাড়ানো হয়েছে।
সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন তরফদার এ প্রসঙ্গে বলেন, অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি প্রতিদিনই বাড়ছে। ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ, নতুন নতুন জেটি নির্মাণ, টার্মিনাল নির্মাণসহ সামগ্রিক সক্ষমতা বাড়াতে চট্টগ্রাম বন্দর নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে।
তিনি বলেন, টার্মিনাল অপারেটর হিসেবে সাইফ পাওয়ারটেক বন্দরের সিসিটি-এনসিটিতে কেবল কনটেইনার হ্যান্ডলিং বা ব্যবসাই করছে না; পেশাদারিত্বের সবটুকু দিয়ে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির বিষয়টি মাথায় রেখেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ রোববার সন্ধ্যায় বলেন, শত সীমাবদ্ধতা ও সংকটের মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দরকে এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি। বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং এক যুগে অন্তত চারগুণ বেড়েছে। বেড়েছে বন্দরের আয়-ব্যয়ও।
এ সময়ের ব্যবধানে ৯৮ থেকে বিশ্বের শীর্ষ বন্দরগুলোর তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৪তমে উন্নীত হয়েছে। আগামী ২ বছরের মধ্যে এ অবস্থান ৫০ এর ভেতরে নিয়ে আসা হবে।
বন্দর চেয়ারম্যান আরও বলেন, এ প্রবৃদ্ধি ও সক্ষমতার জন্য অবশ্যই টার্মিনাল অপারেটরের ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি আমদানিকারক, বার্থ অপারেটর, চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক থেকে শুরু করে সমস্ত স্টেকহোল্ডার ও ব্যবহারকারীদের ভূমিকা অপরিহার্য। কারণ সবার সহযোগিতা না পেলে বন্দরের মতো এতবড় একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
বন্দরের প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালে কনটেইনার ইয়ার্ড ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের ডিপিপি পাস হয়েছে উল্লেখ করে জুলফিকার আজিজ যুগান্তরকে বলেন, এটি হাতে পাওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব এ টার্মিনাল ও ইয়ার্ড নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি আমরা।
সানবিডি/ঢাকা/যুগান্তর/এসএস