ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে এ বছরের ২৭ মার্চ শ্লীলতাহানি করেন ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। ওই দিন নুসরাতের মা মামলা দায়ের করলে গ্রেপ্তার হন সিরাজ। ২৮ মার্চ তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এর পরদিন আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের তত্ত্বাবধানে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করা হয়। একই দিন আরেক কাউন্সিলর মামুনের নেতৃত্বে অধ্যক্ষের বিপক্ষেও মানববন্ধন হয়। পরদিন ফেনীর জেলখানায় গিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন এ মামলার আসামি নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, আবদুল কাদের, জাবেদ, রানা, অধ্যক্ষের স্ত্রীসহ সাতজন।
আরো পড়ুন: যেভাবে হত্যা করা হয় নুসরাতকে
কারাগারে ছক:
১. এপ্রিল শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, ইমরান, আব্দুল কাদের, রানা কারাগারে গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ করেন। সেখানে অধ্যক্ষ সিরাজ তার মুক্তির ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালাতে বলেন। মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল শামীম। এর ফলে কাউন্সিলর মাকসুদ ও আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের সঙ্গে দেখা করে নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো প্রয়োজনে অন্য কিছু করার পরিকল্পনা করেন শামীম।
আরো পড়ুন: নুসরাত হত্যায় অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের ফাঁসি
৩. এপ্রিল আবার জেলখানায় সিরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৫ জন। ৪ এপ্রিল বিকেলে মাদ্রাসার দক্ষিণ পাশের টিনশেড ভবনের পাশে অধ্যক্ষের পক্ষে প্রথম বৈঠক হয়। সেখানে নূর উদ্দিন, জোবায়েরসহ ছয়জন উপস্থিত ছিল। দ্বিতীয় বৈঠক হয় সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। ওই বৈঠকে ২০ সদস্যের অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তির জন্য পরিষদ গঠন হয়। দ্বিতীয় দফার বৈঠকে উপস্থিত ছিল ১৬ জন।
৪. এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মাদ্রাসার পশ্চিম পাশের তৃতীয় তলার ছাত্র হোস্টেলে তৃতীয় দফায় বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিল নূর উদ্দিন, শামীম, জোবায়ের, কাদেরসহ ১০ জন। হত্যায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম কেনায় অর্থ দেয় কাউন্সিলর মাকসুদ আলম। কেরোসিন কেনে শামীম, বোরকা ও হাতমোজা কিনেছে কামরুন্নাহার মনি। এর আগে উম্মে সুলতানা পপির মাধ্যমে শামীমের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা পায় মনি।
যেভাবে গায়ে আগুন দেওয়া হয়: ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শামীম, নুর উদ্দিন, আব্দুল কাদের মাদ্রাসার সামনে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে যার যার অবস্থানে চলে যায় অন্যরা। শামীমের পলিথিনে নিয়ে আসা কেরোসিন ও অধ্যক্ষের সামনের কক্ষ থেকে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেওয়া হয়। কামরুন্নাহার মনির কেনা দুটি ও বাড়ি থেকে আনা একটিসহ মোট ৩টি বোরকা ও ৪ জোড়া হাতমোজা নিয়ে রাখা হয় সাইক্লোন সেন্টারের তিন তলায়। শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাতমোজা পরা অবস্থায় তৃতীয় তলায় অবস্থান নেয়।
নুসরাত পরীক্ষা দিতে গেলে উম্মে সুলতানা পপি তাকে জানায়, তার বান্ধবীকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। এরপর নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে। নুসরাত সেখানে পৌঁছালে পপি তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে। নুসরাত মামলা তুলবে না এটা বলতে বলতে পপির সঙ্গে ছাদে উঠতে থাকলে কামরুন্নাহার মনি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ তাদের পেছনে পেছনে যায়। সেখানে নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি প্রদান করে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলা হয়।
মামলা তুলতে রাজি না হওয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়। এরপর শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পেছন দিকে নিয়ে আসে। উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না দু'ভাগ করে ফেলে। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পেছনে বেঁধে ফেলে, অন্য অংশ দিয়ে জোবায়ের পেঁচিয়ে ফেলে পা। পায়ে গিঁট দেয় জাবেদ। সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিলে শাহাদাত মুখ ও গলা চেপে রাখে তার। কামরুন নাহার মনি বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং উম্মে সুলতানা পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাচের গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেয়।
শাহাদাতের ইশারায় ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় জোবায়ের। আগুন ধরিয়ে প্রথমে জোবায়ের ছাদ থেকে নামে, এরপর উম্মে সুলতানা পপি ছাদ থেকে নেমে যেতে থাকে। ওই সময় আগের শেখানো মতে কামরুন নাহার মনি উম্মে সুলতানা পপিকে 'কাম কাম চম্পা/শম্পা' বলে ডেকে নিচে নেমে যায়। কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। জাবেদ ও শাহাদাত হোসেন শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরকা খুলে ফেলে।
জাবেদ শাহাদাতকে তার বোরকা দিয়ে দ্রুত নেমে পরীক্ষার হলে ঢোকে। শামীম নেমে মাদ্রাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যায় ও মাদ্রাসার পুকুরে বোরকা ফেলে দেয়। জোবায়ের সাইক্লোন সেন্টার থেকে নেমে মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় এবং বোরকা ও হাতমোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়। নুর উদ্দীন সাইক্লোন সেন্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকির দায়িত্ব পালন করে।
মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারারত থাকে। মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের পাহারারত থাকে।
খুনিদের নাটক:
নুসরাত অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসার পর কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নেভায়। ওই সময় হত্যা পরিকল্পনায় যুক্ত নুর উদ্দীনও নুসরাতের গায়ে পানি দেয় এবং আব্দুল কাদের নুসরাতের ভাই নোমানকে ফোনে সংবাদ দেয়। পরে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর তার হাতের মধ্যে কাচের গ্লাস ঢুকিয়ে রাখে চম্পা; যাতে সবার ধারণা হয় ঘটনাটি আত্মহত্যা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বৃহস্পতিবার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। সকাল ১১টার কিছু পর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এই টাকা আদায় করে নুসরাতের পরিবারকে দেওয়ার আদেশ দেন বিচারক।
আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারিত এ দিনে সকালেই আসামিদের আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। রায় শোনার পর আসামিরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন এবং কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, স্থানীয় কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আবদুুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, অধ্যক্ষের শ্যালিকার মেয়ে উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আবদুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মহিউদ্দিন শাকিল এবং সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস