পবিত্র কুরআনের ২৩ নং সূরা, সূরাতুল মুমিনুনে আল্লাহ তায়ালা মুমিনের গুণাবলি তুলে ধরেছেন। এই সূরাতে মুমিনের সাতটি গুণের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে’ (সূরা মুমিনুন -১)।
সফলতা দুই ধরনের :
১. দুনিয়াবি সফলতা : সৎ পথে উপার্জন করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখা, হালাল-হারাম মেনে চলা, সর্বোপরি কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
২. পরকালীন সফলতা : রাসূল সা:-এর সুপারিশ লাভ করা, আমলনামা ডান হাতে পাওয়া, হাউজে কাউসারের পানি পান করা, বিজলি আকারে পুলসিরাত পার হওয়া, আরশের নিচে স্থান পাওয়া, জান্নাত লাভ করা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা শিখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে তাঁর কাছে সফলতা চাইতে হবে।
‘আয় রাব্বুল আলামিন, আমাদেরকে দুনিয়ার কল্যাণ এবং পরকালীন কল্যাণ দান করুন’ (সূরা বাকারা-২০১)।
পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে :
‘যারা পাপ কাজ থেকে বিরত তারাই প্রকৃত সফলকাম’ ( সূরা আলা -১৪)।
‘তোমরা দুনিয়াকে পরকালের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকো, অথচ দুনিয়ার তুলনায় পরকাল উত্তম, কারণ সেখানেই আসল সফলতা’ ( সূরা আলা -১৬-১৭)।
মুমিনের গুণাবলি আলোকপাত করা হলো :
মুমিনের সর্বপ্রথম গুণ হলো ঈমানদার হওয়া। এটি মৌলিক বিষয়, তাই এইটাকে আলাদা করে সাত ভাগ করা হয়েছে।
মুমিনের প্রথম গুণ : খুশু-খুজুসহ নামাজ আদায় করা।
‘যারা নিজেদের নামাজ খুশু-খুজুসহ আদায় করে’ (সূরা মুমিনুন-২)।
নামাজে খুশু-খুজু হলো বিনয়, নম্র হওয়া। এর আভিধানিক অর্থ হলো, স্থির থাকা, অনর্থক নড়চড় না করা, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কল্পনাকে অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে উপস্থিত না করা।
আবুযর রা: থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি তার সালাতে দণ্ডায়মান থাকাকালীন পর্যন্ত রহমতের দৃষ্টিপাত করতে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত না করে। যখন সে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে, তখন আল্লাহ তায়ালাও তার থেকে রহমতের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন’ (আন-নাসায়ি, হাদিস নং ১১৯৫)।
অন্য হাদিসে রাসূল সা: হজরত আনাস রা:কে নির্দেশ দেন : ‘নামাজে সিজদার জায়গার দিকে দৃষ্টি রাখো এবং ডানে-বামে ভ্রুক্ষেপ করো না’ ( বায়হাকি)।
আরেক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, ‘রাসূল সা: এক ব্যক্তিকে নামাজে দাড়ি নিয়ে খেলা করতে দেখে বললেন, খুশু-খুজু থাকলে সে স্থির থাকত’ (মাজহারি)।
মুমিনের দ্বিতীয় গুণ : অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা।
‘তারা অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে’ (সূরা মুমিনুন- ৩)। অনর্থক কথাবার্তা বলতে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা। অর্থাৎ যাতে কোনো উপকার নেই, বরং ক্ষতি বিদ্যমান। এর থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।
রাসূল সা: বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন অনর্থক বিষয় ত্যাগ করে, তখন ব্যক্তির ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়’ (মারেফুল কুরআন-পৃষ্ঠা-৯১৩)।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা (মুমিনগণ) যখন বেহুদা কাজকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন স্বীয় মর্যাদার সাথে তা পরিহার করে’ (সূরা ফুরকান-৭২)।
মুমিনের তৃতীয় গুণ : ‘জাকাত দেয়া। যারা জাকাত দিয়ে থাকে’
(সূরা মুমিনুন- ৪)।
জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। এটি বিত্তবানদের ওপর ফরজ। জাকাত শব্দের অর্থ হলো, পবিত্র হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। পরিভাষায়, শরিয়ত নির্ধারিত সম্পদ এক বছর পূর্ণ হওয়া সাপেক্ষে নির্দিষ্ট শর্তসহ দান করাকে জাকাত বলে। খলিফা হজরত আবু বকর রা:-এর সময় জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তিনি।
পবিত্র কুরআনে নামাজ এবং জাকাতের কথা ৮২ বার উল্লেখ করা হয়েছে।
মুমিনের চতুর্থ গুণ : লজ্জাস্থান সংযত রাখা। ‘অর্থাৎ যারা নিজেদের লজ্জাস্থান সংযত রাখে’ (সূরা মুমিনুন-৫)।
সাহল ইবনে সাদ রা : থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অঙ্গ (জিহবা) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী অঙ্গ (গুপ্তাঙ্গ) সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেবো’ (বুখারি ৬৪৭৪, ৬৮০৭, তিরমিজি ২৪০৮, আহমাদ ২২৩১৬)।
পবিত্র কুরআনে নির্দেশিত হারাম নারীকে বিয়ে করাও এর অন্তর্ভুক্ত। স্ত্রীর সাথে হায়েজ-নেফাস অবস্থায় কিংবা অস্বাভাবিক পন্থায় সহবাস করা অথবা জীব-জন্তুর সাথে মিলনের সবগুলো এর শামিল। বেশির ভাগ তাফসিরকারকের মতে, হস্তমৈথুনও এর অন্তর্ভুক্ত (বায়ানুল কুরআন)।
মুমিনের পঞ্চম গুণ : আমানত রক্ষা করা। পবিত্র কুরআনে মুমিনের গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা নিজেদের ওয়াদা এবং আমানত রক্ষা করে’ (সূরা মুমিনুন-৮)।
আমানত দুই ধরনের,
১.আল্লাহ প্রদত্ত।
২. বান্দা সম্পর্কীয়।
* আল্লাহ প্রদত্ত আমানত হলো : ক্ষমতা, অর্থ সম্পদ এবং মানব দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এগুলোর সদ্ব্যবহার।
* বান্দা সম্পর্কই আমানত হলো : টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখলে তা যথাসময়ে বুঝিয়ে দেয়া। কেউ কোনো গোপন কথা বললে তা অবশ্যই গোপন রাখা। মালিক তার অধীনস্থ কর্মচারীদের পাওনা যথাসময়ে দিয়ে দেয়া।
এবং কর্মচারী তার মালিকের কাজ সঠিকভাবে আদায় করাও আমানতের শামিল। উল্লিখিত বিষয়গুলোর বিপরীত স্বভাব হলো মুনাফিকের।
হাদিসে বলা হয়েছে, মুনাফিকের আলামত তিনটি,
১. কথা বললে মিথ্যা বলে।
২. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে।
৩. আমানতের খেয়ানত করে। (বুখারি- ২৬৮২,২৭৪৯ মুসলিম- ১১৪,১১৫)।
মুমিনের ষষ্ঠ গুণ : ওয়াদা রক্ষা করা। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, (মুমিনগণ) ‘ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করে’ (সূরা মুমিনুন-৮)।
অঙ্গীকার বলতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বুঝায়, যা কোনো ব্যাপারে উভয়পক্ষ অপরিহার্য করে নেয়, এরূপ চুক্তি পূর্ণ করা ফরজের খেলাপ করা প্রতারণা তথা হারাম।
আবার, আর এক প্রকার অঙ্গীকার হলো : একতরফাভাবে একজন অন্যজনকে কিছু দেয়া অথবা অন্যজনের কোনো কাজ করে দেয়ার চুক্তি করা’ (মারেফুল কুরআন, বাদশা ফাহাদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্প’ (পৃষ্ঠা-৯১৩)।
হাদিসে বলা হয়েছে, ‘ওয়াদা একপ্রকার ঋণ, আর এ ঋণ আদায় করা যেমনি ওয়াজিব, ওয়াদা পূরণ করাও তেমনি ওয়াজিব। শরিয়তের কোনো কোনো কারণ ছাড়া এর খেলাপ করা কবিরা গুনাহ’ (মাআরেফুল কুরআন, বাদশা ফাহাদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্প’ (পৃষ্ঠা-৯১৩)।
মুমিনের সপ্তম গুণ : নামাজে যতœবান হওয়া। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা (মুমিনগণ) নিজেদের নামাজে যতœবান’ (সূরা মুমিনুন-৯)। নামাজে যতœবান হওয়ার অর্থ হলো নামাজে পাবন্দী করা এবং প্রত্যেক নামাজ মুস্তাহাব অর্থ আদায় করা। (রুহুল মাআনি)। অন্যত্রে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সালাত মুমিনের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ’ (সূরা নিসা-১০৩)।
পবিত্র কুরআনের সূরা মাউনে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংস ওইসব নামাজির, যারা তাদের নামাজে বেখবর’ (সূরা মাউন- ৪-৫)।
যেসব মুসল্লি সালাতের ব্যাপারে উদাসীন তাদের কঠিন ধমক ও জাহান্নামের হুমকি দেয়া হয়েছে। ইবনু আব্বাস রা: বলেন : ‘এরা হচ্ছে মুনাফিক অর্থাৎ যারা সবার সাথে থাকলে সালাত আদায় করে, কিন্তু একাকী বা গোপনে থাকলে সালাতের ধার ধারে না। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : ( লিল মুসল্লিন) অর্থাৎ যারা সালাত আদায়কারী এবং সালাতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে সালাতের ব্যাপারে অলসতা প্রদর্শন করত: হয় সালাত সম্পূর্ণ বর্জন করে অথবা শরিয়ত নির্ধারিত সময়ে আদায় না করে অথবা সালাত রাসূলের শেখানো পদ্ধতিতে আদায় না করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন :
তাদের পরে এলো অপদার্থ পরবর্তীগণ, তারা সালাত নষ্ট করল ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে’ (সূরা মারইয়াম-৫৯)। তাই প্রসিদ্ধ তাবেয়ি মাসরূক, আবু যুহা ও আতা বিন দীনার রহ: বলেছেন : ‘আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা তিনি (আন সালাতিহিম ছাহুন) এ কথা বলেছেন, (ফি সালাতিহিম ছাহুন) বলেননি। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার এ কথার অর্থ হলো : তারা সালাতের ব্যাপারে উদাসীন। সালাতের মাঝে উদাসীন এ কথা বলেননি। কেননা যারা সালাতের ব্যাপারে উদাসীন তারা হয়তো নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবেই সালাতের উত্তম সময় থেকে বিলম্ব করে মাকরূহ সময়ে আদায় করে, আবার হয়তো বিনয় নম্রতাসহ সালাতের রুকন-আরকান ও শর্তগুলো ভালোভাবে আদায় করে না।
তাই নবী সা: বলেন ‘ওটা মুনাফিকের সালাত (তিনবার বলেছেন)। সে সূর্য অস্তমিত যাওয়ার প্রতীক্ষায় বসে থাকে, সূর্য অস্ত যেতে শুরু করে এমনকি তা শয়তানের দুই শিংয়ের মাঝামাঝি চলে যায়, তখন সে দাঁড়িয়ে চারটি ঠোকর মারে। অল্প সময় ছাড়া তারা আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণই করে না’ ( মুসলিম- ১৪৪৩)।
মূলত ইবাদত করা উচিত একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তায়ালার জন্যই। রাসূল সা: বলেন, ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করবে যেন তুমি আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে পাচ্ছ, আর তা না পারলে এমন বিশ্বাস নিয়ে ইবাদত করবে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন’ (সহিহ বুখারি হাদিস-৫০, সহিহ মুসলিম হাদিস-১০২)
লক্ষণীয় যে, সাতটি গুণের শুরু এবং শেষ উভয়টা হয়েছে নামাজ দিয়ে। এর থেকে বুঝা যায়, নামাজের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
একজন মানুষ যখন আরকান-আহকামসহকারে নামাজ আদায় করে তখন তার অন্য কাজগুলো আপনা আপনি ঠিক হয়ে যায়।
পরিশেষে মুমিনদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তারাই উত্তরাধিকারী লাভ করবে এবং জান্নাতুল ফেরদাউসের বাসিন্দা হবে, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল’ (সূরা মুমিনুন-১০-১১)।
এখানে উত্তরাধিকারী বলার কারণ হলো যে, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি যেমন উত্তরাধিকারীদের মালিকানায় আসে, তেমনি জান্নাত নামক সম্পত্তিতে আমাদের উত্তরাধিকারের অংশ রয়েছে। আমাদের উত্তরাধিকারীরা হলেন হজরত আদম আ:, ইবরাহিম আ: এবং হজরত মুহাম্মদ সা:। আমরা যদি আমাদের উত্তরাধিকারীদের রেখে যাওয়া পথে চলতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি তথা জান্নাতে পৌঁছে যাবো ইনশাআল্লাহ।
লেখক : প্রাবন্ধিক
সানবিডি/ঢাকা/এসএস