উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো সময় পার করছে। কিন্তু এত ভালোর মধ্যেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। এ খাতের বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত কর্মসংস্থান। কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়ায় থমকে পড়েছে কর্মসংস্থানও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগ না হলে নতুন নতুন কলকারখানা তৈরি হবে না। কলকারখানা তৈরি না হলে মানুষের কর্মসংস্থানও হবে না। তারা বলছেন, দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি থমকে আছে। উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ব্যাংকের তারল্য সংকট, উচ্চ ঋণের সুদহার ও অবকাঠামোগত সমস্যা অন্যতম। এছাড়া নতুন বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশও নেই। এসব কারণে ধারাবাহিক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি না বেড়ে উল্টো কমে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ একটা জায়গায় আটকে আছে। এর মূল কারণ যথাযথ বিনিয়োগ পরিবেশের অভাব। এর মধ্যে অন্যতম হলো- অবকাঠামোগত সমস্যা ও ব্যাংক খাতে অর্থের সংকট। এছাড়া দেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, যা গুটি-কয়েক গোষ্ঠীর কাছে কুক্ষিগত। এ কারণে অনেক উদ্যোক্তা ইচ্ছা সত্ত্বেও যথাযথ পরিবেশ না পেয়ে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। ফলে চাহিদা সত্ত্বেও অনেক শিল্পের বিকাশ ঘটছে না।
জাহিদ হোসেনের মতে, সরকারি নিয়মনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সততার অভাব রয়েছে। কাউকে বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে আবার কাউকে তেমন সুবিধাই দেয়া হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের সমস্যা দূর করতে হবে। এটা করতে পারলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও সক্ষমতা বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। চলতি বছরের আগস্ট মাস শেষে বার্ষিক ঋণপ্রবৃদ্ধি নেমে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ হার ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বনিম্ন। ওই সময়ে ঋণপ্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের আগস্টের তুলনায় চলতি বছরের (২০১৯) আগস্টে বেসরকারি ঋণপ্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগে জুলাই শেষে বেসরকারি ঋণপ্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর আগের মাস জুনে ঋণপ্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।
আগস্ট মাস শেষে বেসরকারি খাতে বিতরণ করা ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ সাত হাজার ৩৯৮ কোটি টাকায়। গত বছরের একই সময় শেষে ঋণস্থিতি ছিল নয় লাখ ১০ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে ঋণস্থিতি বেড়েছে ৯৭ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। এর আগে জুলাই মাসে ঋণস্থিতি ছিল ১০ লাখ দুই হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা।
শুধু ব্যাংক নয়, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিকপ্রতিষ্ঠানেরও ঋণস্থিতি কমছে। আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণস্থিতি ছিল ৬৭ হাজার কোটি টাকা। যা গত মার্চ শেষে ছিল ৬৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ হিসাবে মার্চের তুলনায় জুনে ঋণস্থিতি না বেড়ে উল্টো কমেছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। তবে আগের তিন প্রান্তিকে ঋণস্থিতি সামান্য বেড়েছে। সব মিলিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণপ্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০১৮ সালের জুন শেষে আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণস্থিতি ছিল ৬৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
এদিকে মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে মাইক্রোক্রেডিটের হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ক্ষুদ্র ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘নানা কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংক ও আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী আমানত মিলছে না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। অবকাঠামোগত সমস্যা, ঋণের উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন কারণে অনেক উদ্যোক্তা ঝুঁকি নিয়ে ঋণও নিতে চাচ্ছেন না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে গেছে।’
‘বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এ খাতে ঋণের চাহিদাও কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে। যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে চাপে ফেলছে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘অর্থনীতির সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে কোনো সমন্বয় পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে জোর করে সমন্বয় করতে দেখা যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি খাত চাঙা করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি ঋণের চাহিদাও বাড়বে। তখন অর্থনীতি সঠিক পথে এগিয়ে যাবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে বেসরকারি খাতের ঋণ হু-হু করে বেড়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতে সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ঋণপ্রবৃদ্ধি হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। ফলে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ২০১৮ সালের শুরুতেই ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে ঋণপ্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও নানা কারণে ঋণপ্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। নিম্নমুখীর ধারা অব্যাহত আছে। তবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডিআরের হার বাড়িয়ে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই আগামীতে ঋণপ্রবৃদ্ধি বাড়বে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে জুন-নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু এর বিপরীতে ঋণপ্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। এর আগে প্রথমার্ধে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও অর্জিত হয় মাত্র ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এদিকে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি কমিয়ে চলতি অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন এ মুদ্রানীতি কর্মসংস্থানমুখী ও প্রবৃদ্ধি-সহায়ক, বলেন গভর্নর ফজলে কবির। নতুন মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। যা গেল অর্থবছরের জুন পর্যন্ত লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রক্ষেপণ ছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু গত জুন শেষে এ খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এটি গত অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম। এখন বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি আরও কমেছে।
সানবিডি/ঢাকা/জাগো নিউজ/ এসএস