দেড় মাস আগে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৫০ টাকা। চার ধাপে দাম বেড়ে তা এখন ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বর্তমানে এক কেজি পেঁয়াজের দামে প্রায় চার কেজি মোটা চাল পাওয়া যাচ্ছে।
অথচ নতুন করে পেঁয়াজের আমদানি খুবই সামান্য। ভারতের বাজারের দোহাই দিয়েই এ দাম বাড়ানো হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ায় দেড় মাসে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিল পেঁয়াজ সিন্ডিকেট।
এর বড় অংশই গেছে আমদানিকারকদের পকেটে। সবমিলিয়ে পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে পুরো দেশ। আর সিন্ডিকেট ভাঙতে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকার বলছে, শিগগিরই দাম কমে আসবে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নিত্যপণ্যটির দাম যেভাবে বাড়ছে, তা স্বাভাবিক নয়। এটি এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
তার মতে, পণ্যের দাম বাড়লে একজন আরেকজনের দোষ দেয়। তবে বিষয়টি নজরদারির দায়িত্ব সরকারের। কোনো ধরনের কারসাজি হলে তাদেরই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
১২ সেপ্টেম্বর দেশের বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা কেজি। পরদিন ভারত পেঁয়াজের রফতানি মূল্য বাড়িয়ে ৮৫২ ডলার করে। এমন খবরে সেদিন দেশের বাজারে ২৫-৩০ টাকা বাড়িয়ে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৮০ টাকা। এই দর অব্যাহত থাকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা থাকে ২৪ লাখ টন। সে হিসাবে এক মাসের চাহিদা ২ লাখ টন। একদিনে চাহিদা ৬ হাজার ৬৬৬ টন।
সে অনুযায়ী, একদিনে ৩০ টাকা বাড়ানো হলে ১১ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে কাটা হয়েছে প্রায় ২২০ কোটি টাকা। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর সংকটের কথা জানিয়ে নতুন করে ৫ টাকা বাড়িয়ে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৮৫ টাকায়, যা দুইদিন ধরে বিক্রি হয়। এ দুইদিনে ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত ৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
২৬ সেপ্টেম্বর আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে ৯০ টাকা বিক্রি করে শুরু করে সিন্ডিকেট। ২৯ সেপ্টেম্বর বিকাল পর্যন্ত ওই দরে বিক্রি করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক বিক্রির হিসাব অনুযায়ী এ সময়ে প্রায় ২৬ হাজার ৫০০ টন পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ওই দরে। এতে ভোক্তার পকেট থেকে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে ১০৬ কোটি টাকা।
ভারত থেকে আমদানি বন্ধের অজুহাতে ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এক লাফে পেঁয়াজের দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে ১৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এতে এক মাসে ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত কেটে নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ চার ধাপে ভোক্তার পকেট থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, পণ্যমূল্যের ওঠানামা বাজারের ধর্ম। তবে দাম যখন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে, তখন জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। তাই এটা দূর করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে চাহিদা নিরূপণ করে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। তারা একবার দাম বাড়ালে আর কমান না।
তার মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো তেমন কার্যকর নেই, যে কারণে সিন্ডিকেট ধরা যাচ্ছে না।
সরেজমিন সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২৫-১৩০ টাকা কেজি দরে। আর মাঝারি মানেরটা ১২০ টাকা। এছাড়া ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০০-১১০ টাকা কেজি। কারওয়ান বাজারের খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি দরে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. আমানত আলী বলেন, আমরা কমিশনে বিক্রি করি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আমদানিকারকরা। তারা যে রেট (দর) দেয়, সেই দামে আমাদের বিক্রি করতে হয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমদানিকারকদের প্রতি সরকারের নজর দিতে হবে।
এদিকে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পেঁয়াজের দাম নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দু-একদিনের মধ্যে পেঁয়াজের বড় চালান দেশে পৌঁছলে দাম দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ রয়েছে। প্রতিদিন আমদানিকৃত পেঁয়াজ আসছে।
সরবরাহ ও দাম স্বাভাবিক রাখতে মন্ত্রণালয় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পেঁয়াজের দাম কম ও সহজ পরিবহনের কারণে ভারত থেকে প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
ভারতের মহারাষ্ট্র ও অন্য এলাকায় বন্যার কারণে পেঁয়াজের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে কিছুদিন আগে রফতানির ক্ষেত্রে ভারত প্রতি টন পেঁয়াজের ন্যূনতম রফতানি মূল্য নির্ধারণ করে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম এখন লাগামহীন। সোমবারও এখানকার পাইকারি বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা।
মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৯৫ থেকে ১০০ টাকা। আর মিসরের পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়। খুচরা বাজারে গিয়ে পেঁয়াজের কেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রোববার চট্টগ্রামে একটি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী পেঁয়াজের সংকট কাটতে সময় লাগবে আরও এক মাস- এমন বক্তব্য দিয়ে যাওয়ার পর পেঁয়াজের আড়তদার ও আমদানিকারকরা দাম ঊর্ধ্বমুখী করতে যেন আরও একটু সাহস পেয়েছেন।
সোমবারও যার আঁচ পাওয়া গেছে খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারে। এদিকে রোববার রাতে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজবাহী ২০টি ট্রাক খাতুনগঞ্জে ঢুকেছে। এ ছাড়াও আগের এলসি করা ৬ থেকে ৮ ট্রাক পেঁয়াজ চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। গত মৌসুমে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭ লাখ টন নষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ২২ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত দেশে ১ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও বলছে, দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। সূত্র আরও বলছে, দুই সময়ে পেঁয়াজ বেশি আমদানি হয়। প্রথমত, দুই ঈদে, সে সময় পুরো আমদানির ৪০ শতাংশ আনা হয়। আর দ্বিতীয়ত নভেম্বর-ডিসেম্বরে।
সানবিডি/ঢাকা/যমুনা টিভি/এসএস