লতা মঙ্গেশকরের জীবনের অজানা তথ্য
প্রকাশ: ২০১৫-০৯-২৮ ১৮:৫৫:১০
অদ্ভুত এক মোচড়! তীব্র যন্ত্রণা। ঘুম ভাঙল, অস্বস্তি নিয়েই।
কিছুতেই স্থির থাকা যাচ্ছে না। বাথরুম আর ঘর– করতে করতে ক্রমশই শক্তি কমছিল। বার তিনেক বমিও হলো। সবজে সবজে রঙ। কী হলো! কী করে হলো? উৎকণ্ঠ বাড়ছিল। বাড়ছিল অসুস্থভাবও।
যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে, এক সময় জ্ঞান হারাল। তারপর, আর কিছু মনে নেই।
তাঁর মনে নেই বটে। তবে আশে-পাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মনে আছে। তাঁরাই তড়িঘড়ি ডাক্তারকে খবর দিয়েছিলেন। ডাক্তার এসে থমকে ছিলেন, রোগীকে দেখার পর। অবস্থা যে তখন মোটেই ভালো নয়। নিস্তেজ শরীরটা পড়ে আছে বিছানার ওপর। পরিস্থিতি সামাল দিতে, ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু রোগীর শরীর নিয়ে কোনো কথা দিতে পারেননি। তারপর? যমে-মানুষে টানাটানি বলতে যা বোঝায়, দিন তিনেক চলেছিল তেমনই। শেষে জ্ঞান ফিরল। কিন্তু, বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা হারিয়ে গেল!
কী এমন হয়েছিল? কারই বা হয়েছিল শরীরের এমন অবস্থা?
লতা মঙ্গেশকর।
যে ঘটনার উল্লেখ করে লেখার শুরু, তা ঘটেছিল ১৯৬২-তে। লতা তখন ৩৩-এ। এত কম বয়সে, যমে-মানুষে টানাটানির অবস্থা তৈরি হয়েছিল কেন? আসলে লতাকে যে বিষ দেওয়া হয়েছিল! এমন বিষ, যা ধীরে ধীরে কাজ করে। যা একটু একটু করে নিস্তেজ করে দেয় শরীর। লতার সঙ্গেও ঘটেছিল তাই।
প্রশ্ন হলো, কে দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরকে বিষ? না, সে তথ্য সামনে আসেনি। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওই ঘটনার পর, লতার বাড়িতে যিনি রান্নার কাজ করতেন অনেকদিন ধরে, তিনি উধাও হয়ে যান! অনেক খোঁজাখুঁজির পরও হদিস মেলেনি। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ওই রাঁধুনি নিজের জিনিসপত্র, টাকা-পয়সা নিয়েই পালিয়েছিলেন। অর্থাৎ আটঘাঁটা যে আগেই বাঁধা ছিল, তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। জানা যায়, ওই রাঁধুনি একসময় বলিউডের এক নামকরা অভিনেতার বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন। পরে লতার বাড়িতে কাজ নিয়েছিলেন।
এমন ভয়ানক ঘটনার ছায়া পেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বেশ অনেকটাই সময় লেগেছিল সুর সম্রাজ্ঞীর। তিন মাস বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতাই ছিল না তাঁর। গান-বাজনা তো দূর, কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতেও মন চাইত না। ডাক্তার পথ্য দিয়েছিলেন, ঠাণ্ডা স্যুপ খাওয়ার। তাতে যেন বরফ টুকরো দেওয়া থাকে, পইপই করে সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসক। হঠাৎ এমন খাবার খেতে বলার কারণ? লতা তখনও যে পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। অন্ত্রে অসম্ভব জ্বালা-যন্ত্রণা ছিল। অতগুলো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও!
কিন্তু, লতার মতো গায়িকা এভাবে ফুরিয়ে যান, এভাবে অসুস্থ হয়ে পরে থাকুন বিছানায়, চাননি মজরু সুলতানপুরী। প্রায় রোজ সন্ধ্যেয় তিনি এসে হাজির হতেন লতার বাড়িতে। গায়িকার দেখভালের জন্য অনেক লোক থাকলেও, মজরু সাহেবের তাঁদের ওপর ঠিক আস্থা রাখতে পারতেন না। যা ঘটে গিয়েছিল, তারপর ভরসা রাখা সত্যিই ছিল কঠিন। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন লতার জন্য তৈরি খাবার সবার আগে চেখে দেখতেন মজরু সুলতানপুরী। খাবার ঠিক আছে বুঝে, তিনি সবুজ সংকেত দিলে, তবে সে খাবার দেওয়া হতো লতাকে। রক্তের সম্পর্কের কেউ বা নিকট আত্মীয় যা করার কথা ভাবেননি, মজরু সাহেব সে দায়িত্বটাই নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। নিজের প্রাণের পরোয়া করেননি এক মুহূর্তের জন্য। আসলে লতা মঙ্গেশকারের মতো গায়িকাকে বাঁচিয়ে রাখার, সুস্থ করে তোলা কতটা জরুরি, সেটা উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। চাননি এভাবে সুরের দুনিয়ার মল্লিকা হারিয়ে যান। যিনি নিজে এত বড় মানুষ, যাঁর কাছ থেকে দুনিয়া এত কিছু পেয়েছেন, তিনি এভাবে জীবনের বাজি রাখবেন, ভাবতে পারেননি অনেকেই। তবে মজরু সাহেবের এই আত্মত্যাগের কথা সবাই যে জানতে পেরেছিলেন সে সময়, এমন নয়। লতার জন্য এটুকু করছেন বলে, প্রচার করে বেড়াতে হবে, এমন চেনা ছকের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। ওই সময়, তিনি প্রকৃত বন্ধু হয়েই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
মজরু সুলতানপুরী, লতার থেকে বয়সে দশ বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু, জীবনের ওই কঠিন মোড়ে তিনি প্রকৃত অর্থেই যেন হয়ে উঠেছিলেন লতার অভিভাবক! তাই তো শুধু খাবার চেখে দেখা নয়, প্রতিদিন নিয়ম করে লতাকে নানা বিষয়ে গল্প বলতেন তিনি। পড়ে শোনাতেন একের পর এক কবিতা। শরীরের জ্বালা, লতার মনও যাতে গ্রাস করতে না পারে, তাই-মন ভালো করার দাওয়াই প্রতি মুহূর্তে খুঁজতেন মজরু। শেষ পর্যন্ত তিনি, নিজের কাজে সফল হন। তিন মাস ধরে চেষ্টা করে যাওয়ার পর, লতার শরীর-মন দুই ভালো হয়। ধীরে ধীরে তিনি ফেরেন কাজের জগতে। গানের দুনিয়ায়। লতাকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে দেখার পরই, স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন মজরু।
সত্যিই এমন মানুষ, এমন বন্ধু, সবার জীবনে আসে না। লতা মঙ্গেশকার পেয়েছিলেন। ভাগ্যিস পেয়েছিলেন। তাই তো আজও তিনি আছেন, আমাদের মাঝে। হৃদয়ের গভীরে।
–আজকাল
সানবিডি/ঢাকা/রাআ