একজন রাজীব এর জীবনী-১২

:: আপডেট: ২০১৯-১২-০২ ১৯:৪৩:১১


আমাদের বর্নাঢ্য জীবন আগাতে থাকে।
গ্যারেজে তিনটা গাড়ি।
চারজন কাজের লোক।
প্রতিদিন ৩০ / ৪০ জন লোকের রান্না হচ্ছে।
কাছের দুরের চার পাঁচজন বাসায় থাকছে।
ঢাকা শহরে কাজের আশায়।
ওরা প্রত্যেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানেই আমার স্বার্থকতা।
যদি-ও রাজীব সাহেব মারা যাওয়ার পর ওরা কোনদিন আমার বাচ্চাদের খবর নেয়নি।
তারপরও ওরা তো ভালো আছে।
ভালো থাকুক কাছের দুরের স্বজনরা।

প্রতি বছর রাজীব সাহেব এর ৩২/৩৩ টা করে ছবি রিলিজ হচ্ছে।
সিডিউল একদিনে চার ছবিতে।
মাঝে মাঝে আমার বেড়ানোর জায়গা ছিলো শুটিং স্পট।
ম্যারেজ ডের দিনগুলোতে বাসায় থাকতে পারতেন না বলে,আমাকে বলতেন,চলো আমার সাথে।
সারাদিন শুটিং এ কেটে যেতো।
শুটিং বেশ কষ্টের কাজ,হাজার পাওয়ার লাইটের সামনে,গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে কোট পরে মারামারি।
যেহেতু উনি নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করতেন,
বেশির ভাগ সময় মারামারি বা ধর্ষন দৃশ্যে থাকতো।
সোহরাব রুস্তম ছবির শুটিং এ,আমি সেটে বসা। ফাল্গুনী ভাবীর সাথে রোমান্টিক দৃশ্য।
কাছে এসে কানে কানে বললেনঃতুমি একটু অন্য সেট থেকে ঘোরে আস।
ঃকেনো?
ঃ তোমার সামনে অন্য কারো সাথে রোমান্টিক দৃশ্য আসবে না।
ঃ লজ্জা লাগে।
এ-ই কথায় উনার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে। ধর্ষণ দৃশ্য থাকলেও আমাকে লজ্জা পেতেন।
আমার সংসার কানায় কানায় পূর্ণ।
ইন্ডিয়া, পাকিস্তান বাংলাদেশ মিলিয়ে একের পর এক ছবি রিলিজ হচ্ছে।
মানুষের সুখ চিরস্থায়ী হয়না,আমাদের ও হলো না।
সুখের আলো নিভে দুঃখের চাদরে ঢেকে গেলো আমার পৃথিবী।

জয় বিজয় এর বয়স নয় বছর এর মত,অক্সফোর্ড এ ক্লাস ফোর এ পড়ে।ভালো রেজাল্ট করে।এখন স্কুল কি হবে? এতদুর ধানমন্ডি পাঠানো যাবেনা।বাসায় টিচার রাখা হলো।

দুইদিন আগে একটা দাওয়াত ছিলো,যাবো কথা দিয়েছিলাম, নতুন বাসায় সংসার গোছানো তিন ছেলে সামলানো আমি একা,দাওয়াতে যাওয়া হয়নি,পরের দিন সকালেই যার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত ছিলো সে হাজির,বিলাপ করে কাঁন্না।

মেয়েটা ছিলো আমার দুর সম্পর্কে আত্মীয়,এক সাথে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি।হাসব্যান্ড এর সাথে ডিভোর্স হ’য়ে যায়।আমার বাসায় আশ্রয় দিলাম,ছোটো বেলায় এক সাথে পড়েছি,কখনো অসম্মান করিনি।আলাদা রুম দেওয়া হলো,তার কাজ ছিলো বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়া।

কাঁচপুর ব্রিজ এর কাছে এক ছেলের সাথে প্রেম করে।নিজের পরিচয় দেয় রাজীব সাহেব এর সালি।আমি কিচ্ছু জানিনা।ভেগে বিয়ে করে। রাজীব সাহেব এর সালি শুনে ছেলের বাড়ি মেনেও নেয়।আমিও ভাবি,আহা বেচারি সুখি হোক,আমাদের নাম দিয়ে যদি কারও সংসার হয় ঠিকানা হয় ক্ষতি কি?

বললোঃতোরা না গেলে আমার বিয়ে ভেংগে যাবে,গরু ছাগল কেনা হয়ে গেছে, রাজীব সাহেব এর সিডিউল নাই, বাড়ি ঘরের এই অবস্থা, যেতে পারি না,কি করি,ও বললো জয় বিজয় কে দে ওদের দেখলে আমার শ্বশুর বাড়ীর লোকজন বিশ্বাস করবে আমি তোর বোন।

মনে মনে বলি আহা আমিও তো গরীব ছিলাম,বাচ্চাদের একদিনের জন্য যাওয়া যদি কারও সুখের কারন হয় যাকনা।রাজীব সাহেবকে ফোন দিয়ে সব বলি,বললেনঃ পাঠাও, কালকে সকালেই যেন চলে আসে।
মেয়েটার বাড়ির সামনে মসজিদ, মসজিদ এর পুকুরে গোসল করতে নেমে আমার বাচ্চারা আর উঠে নি।
সাতার জানতো না।
সবাই বলছিলো ঐ মহিলার নামে মামলা করতে,আমি করিনি।
আমি ওকে ও ক্ষমা করেছি।
শর্ত ছিলো আজীবন আমার সামনে আসবে না।

ওর অপরাধ ছিলো বাচ্চাদের ঠিকমতো খেয়াল রাখেনি।
কাকে কি শ্বাস্তি দিবো,আমার বাচ্চারা তো আর ফিরে আসবে না।

আমার বাচ্চারা হাসতে হাসতে গেলো,পরের দিন লাশ হয়ে ফিরলো।আমার বাবু আমি কেমন করে বাঁচবো? কি নিয়ে বাঁচবো?।অন্যের উপকার করতে গিয়ে আমার জানের টুকরা, নয় বছরের প্রতিটি মুহূর্ত কেমন করে ভুলবো? আমার সাজানো সংসার,কত সাধনায় গড়া স্বপ্ন মুহূর্তে খান খান হয়ে গেলো।

আমার বেঁচে থাকার আর কোন ইচ্ছাই রইলো না।মানসিক ভাবে ভেংগে পড়ি।

জয় বিজয় চলে গেলো আমি একা হয়ে গেলাম,আমার পৃথিবীর সব আনন্দ ওরা নিয়ে গেলো।রাজীব সাহেব এর কাঁন্না কে থামাবে? আমি ছাড়া তার কে আছে? নিজের হাহাকার এক পাশে সরিয়ে রেখে উনার হাল ধরলাম।দিনের পর দিন আমার ঘুম নাই,চোখ বন্ধ করলেই মা মা ডাক কানে আসে।সেই থেকে আজ-ও আমি সারারাত জেগে থাকি।
প্রতিটা প্রহর যন্ত্রনার।

বাচ্চা হারানো একজন মায়ের কেমন লাগে এটা রাজীব সাহেব বুঝেছিলেন কি না আমি জানি না।কাঁদতেন আর বলতেন,সব দোষ তোমার,যেহেতু ওই মহিলা আমার দুর সম্পর্কে আত্মীয়।আমি আমার তুফান আড়াল করে, মায়ের মত,বন্ধুর মত উনার হাত ধরে রাখি।আমার যাই হোক,আমি রাজীব সাহেবকে একা হতে দিই নি।বিয়েতে দেওয়া ওয়াদা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।
উনাকে সান্তনা দিতে দিতে আমি চিৎকার করে,মাটিতে গড়াগড়ি করে এক বেলা কাঁদতেও পারিনি। আমার অসহায় লাগলে রাস্তায় নেমে জোরে দৌড়াতে ইচ্ছে করে,সেই অনন্ত কালের দৌড়, যতক্ষন হুশ থাকবে।
আমি সেই দৌড় টুকুও দিতে পারিনি। আমার পাশে কেও ছিলো না।

একদিন আমার মা খেয়াল করেন,আমি গভীর রাতে ছাদে একা বসে থাকি,গাছের সাথে কথা বলি।ছোট বাচ্চা দীপ এর খবরও রাখি না,আমার ৩য় ছেলে দীপ।আমার বলতে কিছুই রইলো না।এই নতুন বাড়ী কেনার বয়স মাত্র ১৬দিন।বাড়ি দিয়ে আমি কি করবো,আমি কেমন করে বাঁচবো? রাজীব সাহেব এর কমপ্লেন ও থামলো না,কাঁন্নাও থামলো না।আমি কোথায় যাবো? রাজীব সাহেব যেমন সন্তান হারিয়েছেন,আমিও তো হারিয়েছি, আমার মাথায় কে হাত রেখে বলবে,আমি তো আছি।

আমি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি, কাওকে বুঝতে না দিয়ে,আমি উনাকে খাওয়াচ্ছি, ঘুম পাড়াচ্ছি।আমি তো আমার মধ্যে নেই।আমি উনাকে ক্ষমা করেছি। আমার কোন অভিযোগ নেই।সবাই সব পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন না,হয়ত উনিও পারেননি।
হয়ত উনার ধারনা দেবী সহনশীল, নিজেকে সামাল দিতে পারবে,একাই পারবে।আমিও আমাকে সামাল দেওয়ার একাই চেষ্টা করেছিলাম।করতে হয়েছে।

উনি সব কিছুতেই আমার ওপর ভরসা করতেন।আমি যেন মা,উনি অবুঝ সন্তান।

আমি একা জিন্দা লাশ হয়ে সংসারের দায়িত্ব পালন করতে থাকি।
জীবনের সমস্ত কষ্ট যেনো চেখের সামনে এসে অট্টহাসি দিতে থাকে।
কলিজার ভিতরে সারাক্ষণ মা মা ডাক শুনতে থাকি।এখনও শুনি।কোথাও গেলে সবাই যখন জানতে চায়,বলেন তো জয় বিজয় কিভাবে মারা গেলো? সাথে সাথে আমার ভিতরে সন্তান হারা মা জেগে ওঠে,দম বন্ধ হয়ে আসে,মাথা ঝিমঝিম করে সেই মা মা ডাক কানে বাজতে থাকে।অনেক কষ্টে আস্তে করে বলি।অন্য দিন বলি?

আমার এত পাওয়া,গাড়ি বাড়ি টাকা গয়না কোনকিছুরই আর মুল্য রইল না।আমার সাজানো সংসার শেষ হয়ে গেলো।মনের শান্তির জন্য হজ্ব করতে গেলাম, শান্তি কই?
সানবিডি/ঢাকা/এসএস