খেলাপি ঋণই উচ্চ সুদহারের কারণ
:: প্রকাশ: ২০১৯-১২-০৯ ১২:২৬:৫৮
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি দেশের ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তার এ বক্তব্য সংশ্লিষ্ট মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এবারই তিনি স্বীকার করেছেন, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
এর আগে বেশ ক’বারই তিনি বলেছেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কোনোভাবেই বৃদ্ধি পায়নি। অর্থমন্ত্রী বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, আমরা অর্থনীতির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো করলেও একটি ক্ষেত্রে ভালো করতে পারিনি।
আর সেই ক্ষেত্রটি হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা। খেলাপি ঋণ বেড়েছে এটা সত্য; কিন্তু কেন খেলাপি ঋণ বাড়ল সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
১ ডিসেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত এনইসি সম্মেলন কক্ষে দেশের ব্যবসারত বেসরকারি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেছেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে উচ্চ সুদ হারের কারণে। ব্যাংকগুলো অস্বাভাবিক উচ্চ হারে সুদারোপ করছে বলেই ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। ঋণের সুদের হার কমলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এমনিতেই কমে আসবে।
তিনি আরও বলেছেন, বিশ্বের কোনো দেশেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাংলাদেশের মতো এত বেশি নয়। সুদের হার বেশি থাকলে শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
খেলাপি ঋণ সব দেশেই আছে। কিন্তু আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশিই। আর এ জন্য বিশেষভাবে দায়ী হচ্ছে উচ্চ সুদহার। ব্যাংকগুলো যদি সুদের হার কমিয়ে আনত তাহলে খেলাপি ঋণ এভাবে বৃদ্ধি পেত না।
তাই সরকার ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যাংকিং সেক্টরের শীর্ষ নির্বাহী ও চেয়ারম্যানদের বৈঠকের পর ওইদিনই বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটি কয়েকদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা রয়েছে। ওই প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১ জানুয়ারি, ২০২০ তারিখ থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, প্রায় দেড় বছর আগে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সময়ে প্রথমবারের মতো ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে একের পর এক দাবি আদায় করে নেন।
কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত তাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী সুদের হার এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনেননি। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য পরামর্শ দিলেও অনেক ব্যাংক এখনও তা কার্যকর করেনি।
অথচ ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার অঙ্গীকারের বিপরীতে ব্যাংক মালিকরা সরকারের কাছ থেকে অনেক ধরনের সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন।
এসব সুবিধার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার এক শতাংশ কমানো, একই পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে ৪ জন পরিচালক থাকার ব্যবস্থাকরণ এবং অব্যাহতভাবে ৬ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর দায়িত্ব পালন, খেলাপি হওয়ার পর ৫ বছরের পরিবর্তে ৩ বছরের মধ্যেই তা অবলোপনের সুবিধা আদায় ইত্যাদি।
এতসব সুবিধা নিয়েও ব্যাংক মালিকরা ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনেননি। ৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং তিনটি বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গিল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে।
অবশিষ্ট ৫১টি ব্যাংকের ঋণের সুদের এখনও উচ্চ মাত্রায় রয়ে গেছে। সেসব ব্যাংকের গড় সুদহার এখনও সাড়ে ১২ শতাংশের মতো।
এ অবস্থায় সরকার ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা যে কোনো বিচারেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হল, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এভাবে জোর করে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনার সুযোগ কতটা রয়েছে? এ ছাড়া বাজার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যদি সুদের হার না কমে তাহলে জোর করে সুদের হার কমালে তা কতটা টেকসই হবে?
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আইনি সংস্কার হয়েছে তার প্রায় সবই দুষ্ট ঋণগ্রহীতার অনুকূলে। যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে চলেছেন তাদের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চ হারের কারণেই খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু এ বক্তব্য কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বরং বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। খেলাপি ঋণের কারণেই ব্যাংকগুলো ঋণের ওপর উচ্চ সুদহার চার্জ করতে বাধ্য হয়।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কোনো একটি ব্যাংক হয়তো আমানতকারীর কাছ থেকে বার্ষিক ৮ শতাংশ সুদ প্রদানের শর্তে আমানত সংগ্রহ করেছে। সংগৃহীত আমানত এবং নিজস্ব উৎস থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে মোট ১০০ টাকা ঋণ প্রদান করল।
(উল্লেখ্য, ব্যাংক তার বিনিয়োগযোগ্য পুরো অর্থ ঋণ প্রদান করতে পারে না। কিছু টাকা তাকে সংরক্ষিত রাখতে হয়।) শর্ত নির্ধারিত হল, এ টাকার ওপর ঋণগ্রহীতা বার্ষিক ১২ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করবে।
তাহলে সেই ব্যাংকের বছরান্তে আয় হবে ১২ টাকা। এ টাকা থেকে ব্যাংক আমানতকারীকে ৮ টাকা প্রদান করবে আর অবশিষ্ট ৪ টাকা ব্যাংকের অপারেটিং মুনাফা থাকবে।
ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য পরিচালন ব্যয় যদি ২ টাকা হয় তাহলে ব্যাংকের নিট মুনাফা থাকবে ২ টাকা। স্বাভাবিকভাবে ঋণের কিস্তি আদায় হলেই এ নিট মুনাফা অর্জন করা সম্ভব; কিন্তু ব্যাংক যদি ঋণ হিসেবে প্রদানকৃত ১০০ টাকার কিস্তি নিয়মিত আদায় করতে না পারে তাহলে কী হবে?
ব্যাংক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ ব্যাংক যদি ঋণের কিস্তি আদায়ে ব্যর্থ হয় তাহলেও আমানতকারীদের ৮ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করতে হবে। যে ১০০ টাকা ঋণ প্রদান করা হল তার ওপর নির্দিষ্ট হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।
যদি ৫০ টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় তাহলে পরবর্তী বছর তার ঋণদান ক্ষমতা আরও কমে যাবে। তাকে আরও উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা বা সামর্থ্য অস্বাভাবিকভাবে কমে যাবে।
এ অবস্থায় ব্যাংক নিশ্চিতভাবেই ঋণের ওপর আরোপিত সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হবে। কিন্তু যদি ঠিকভাবে ঋণের কিস্তি আদায় হতো তাহলে ব্যাংক তুলনামূলক স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করতে পারত।
এখন আপনারাই বিবেচনা করুন, উচ্চ সুদ হারের কারণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে নাকি খেলাপি ঋণের প্রভাবে উচ্চ সুদ নিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক। ঋণখেলাপিদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে।
এদের মধ্যে একশ্রেণির ঋণখেলাপি আছেন যারা নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। এদের যদি আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান করে তোলা যেত তাহলে তারা আবারও ঋণের কিস্তি প্রদান শুরু করতেন।
এরাই প্রকৃত ঋণখেলাপি। কিন্তু আর একটি শ্রেণি আছে যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করেই ঋণের কিস্তি আটকে রাখে। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের প্রতি কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শন কাম্য হতে পারে না। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণের টাকা নিয়ে তা বিদেশে পাচার করেছেন। ব্যাংকিং সেক্টরের অন্যতম জটিল সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণের স্ফীত অবস্থা বা উপস্থিতি।
এ জন্য ব্যাংকিং সেক্টরের অভ্যন্তরীণ সুশাসনও অনেকটাই দায়ী। ব্যাংকগুলোতে চলছে নানা ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম। একজন ব্যাংকার যদি চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে তার পক্ষে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতিই রোধ করা সম্ভব। কিন্তু সেই নীতিবান কর্মকর্তা আমরা কোথায় পাব?
দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের সমস্যাই সবচেয়ে প্রকট। প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে আমরা কি সত্যি ব্যাংকিং সেক্টরকে খেলাপি ঋণের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে চাই নাকি আরও জটিল সমস্যার মধ্যে এ খাতটিকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাই?
যদি ব্যাংকিং সেক্টরকে সুষ্ঠু ধারায় পরিচালনা করতে হয় তাহলে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। চীন যখন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথ পরিহার করে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে তখন এক পর্যায়ে চীনের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। চীনা কর্তৃপক্ষ তখন ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে।
ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। তাদের রাষ্ট্রীয় কোনো কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতো না। তারপরও যদি তারা ঋণের কিস্তি ফেরত না দিত তাহলে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
দেখা গেল কিছুদিনের মধ্যেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশেও যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক