রপ্তানি বাণিজ্যে বহুমুখীকরণ এবং রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার ব্যাপারে বারবার জোর তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ এবং এ বিষয় সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে জোর দেওয়া হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন এবং রপ্তানি আয় বাড়াতে রপ্তানি বাণিজ্যে বহুমুখীকরণ ও রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা চলছে।
যার প্রকাশ ঘটেছে সবজি রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনের মধ্যেদিয়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গত বছরের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ২৬২ শতাংশ। গত বছরের মোট রপ্তানির পরিমাণ অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে চলতি অর্থবছরের এক-তৃতীয়াংশ সময়ে।
বলা যায়, সবজি রপ্তানিতে নীরব বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। এমনিতে গার্মেন্টসহ যে সব শিল্পপণ্য বিদেশে রপ্তানি হয় তার আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় কাঁচামাল আমদানিতে। কৃষিজাত পণ্যে সে ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় নেই বলা চলে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানির যে অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে তার একটি ক্ষুদ্র অংশকে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে। ঠিকমতো চেষ্টা চালানো হলে এবং জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সবজি রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে ২০ থেকে ৩০ গুণ বেশি আয় বাড়ানো সম্ভব হবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের সবজি রপ্তানি হয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সবজি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ কোটি মার্কিন ডলার। গত চার মাসের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ কোটি ৯ লাখ ডলার, অথচ সেখানে রপ্তানি হয়েছে ১০ কোটি ৫২ লাখ ডলার। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
এক সময়ে বাংলাদেশে কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ও অঞ্চলেই সবজির চাষাবাদ হতো। দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই শুধুমাত্র সবজির চাষ করতেন কৃষকরা। অথচ বর্তমানে দেশের সব এলাকায় সারা বছরেই সবজির চাষ হচ্ছে। এখন ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার সবজি চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে।
সারা দেশে এখন ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ ২০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। ২০১৮ সালে দেশে মাথাপিছু সবজি খাওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০ গ্রাম।
দেশের সীমানা পেরিয়ে এখন বিশ্ববাজারে যাচ্ছে বাংলাদেশের সবজি। নানা প্রতিকূলতার পরও দেশের সবজি রপ্তানিতে যে যুগান্তকারী সাফল্য এসেছে তা ধরে রাখতে হবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত পানে ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হওয়ায় ২০১৩ সালে পান রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এছাড়া পোকামাকড় ও রোগবালাই এবং অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশ থেকে সবজি রপ্তানির ওপর বেশ কয়েক বছর ধরে নন-কমপ্লায়েন্স নোটিফিকেশন জারি করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে আবার ইউরোপের বাজারে সবজি পাঠানো শুরু করেছেন দেশে সবজি রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে হলে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে। কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদনের মাধ্যমেই বিদ্যমান সংকট কাটানো সম্ভব হচ্ছে। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো এখন বাংলাদেশ থেকে সবজি আমদানিতে ঝুঁকেছেন নতুনভাবে। সবজি রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা উচ্চ হারের বিমানভাড়া। সবজি রপ্তানি বাড়াতে বিমানভাড়া সহনশীল পর্যায়ে রাখতে হবে।
বিদেশে সবজির বাজার বাড়াতে হলে আমাদের এখানে নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে। কৃষকদের এ বিষয়ে সচেতন ও ওয়াকিবহাল করতে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে যথেষ্ট উদ্যোগী ও তৎপর হতে হবে। উন্নত আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং অধিক উৎপাদনশীল বীজ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষকদের সবজি উৎপাদনের জন্য ব্যাংকগুলোকে বিশেষ ঋণ প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বল্পসুদ আরোপসহ সহজ শর্তের ভিত্তিতে বিশেষ ঋণ কার্যক্রম গ্রহণ একান্ত জরুরি। লেখক: ব্যাংকার
সানবিডি/ঢাকা/এসএস