মালয়েশিয়া থেকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় এ পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন প্রায় ৪২ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক। এর মধ্যে ডিসেম্বরের আগে ফেরার অনুমতি পেয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। তাদের প্রত্যেককেই এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত করেছে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ। ফলে কালো তালিকার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ থাকছে না তাদের।
জানা গেছে, অবৈধ প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনেক শ্রমিক আটক হচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণেও আটক হচ্ছেন । এ অবস্থায় মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিনা হয়রানিতে দেশে ফেরার সুযোগ দিয়েছে দেশটির সরকার। ‘ব্যাক ৪ গুড’ শীর্ষক এ কর্মসূচির আওতায় দেশে ফেরার সুযোগ নিতে ইমিগ্রেশন অফিসগুলোতে প্রতিদিন শত শত শ্রমিক অনুমতির জন্য ভিড় করছেন। অবৈধ শ্রমিকদের চাপ সামলাতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও কার্যক্রম চালাচ্ছে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ইমিগ্রেশন অফিস খোলা থাকলেও মধ্যরাত থেকেই বিভিন্ন দেশের অবৈধ অভিবাসীরা লাইনে দাঁড়াতে শুরু করছেন। তবে হাজারের বেশি অবৈধ অভিবাসী লাইনে দাঁড়ালেও একটি ইমিগ্রেশন অফিস থেকে প্রতিদিন ইস্যু করা হচ্ছে গড়ে ৪০০টি স্পেশাল পাস। এ সময় তাদের বিভিন্ন মেয়াদে কালো তালিকাভুক্ত করে ১০ আঙুলের ছাপ (ফিঙ্গার প্রিন্ট) নেয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরের আগে স্পেশাল পাস নিয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক, যাদের এক থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত দেশটিতে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে ইস্যু করা স্পেশাল পাসগুলোয় কালো তালিকাভুক্তির সিল দেয়া হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সেলর মো. জহিরুল ইসলাম জানান, শুরুর দিকে কালো তালিকাভুক্তির কথা শোনা গিয়েছিল। তবে এখন আর এমনটা হচ্ছে না। সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে যারাই ফিরতে চান, তাদের পাশে রয়েছে দূতাবাস। এখনো অনেক শ্রমিক আছেন, যারা স্পেশাল পাস নিতে পারেননি। এ কারণে সময় আরো কিছুটা বাড়লে ভালো হয়। ইমিগ্রেশন সেন্টার থেকে পাস নিয়ে যারা ট্রাভেল পাসের আবেদন করছেন, তাদের সেদিনই দেয়া হচ্ছে। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের সঙ্গেও সবসময় যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।
মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট মাস থেকে শুরু হওয়া সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশে ফিরেছেন বিভিন্ন দেশের ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯০১ জন অবৈধ অভিবাসী। এর মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ৩৮ হাজার ৭৩৪। এরপর আরো প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশী ফিরে এসেছেন।
বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘ব্যাক ৪ গুড’ কর্মসূচির আওতায় অনিয়মিত কর্মীদের দেশে প্রত্যাবর্তনে প্রতিদিন গড়ে ২০০-৩০০ ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হচ্ছে। এর আগে বেশকিছু দেশের নাগরিক ছবি বদলে অন্যের ট্রাভেল পারমিট নিয়ে ইমিগ্রেশন বা বিমানবন্দরে গিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাভেল পাস থাকলেও সন্দেহ হলেই উড়োজাহাজে ভ্রমণ করতে দিচ্ছে না এয়ারলাইনসগুলো।
এ প্রসঙ্গে মো. জহিরুল ইসলাম জানান, ছবি বদল করে ভ্রমণ করতে চাওয়ার মতো কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। তবে এখন সেটি হচ্ছে না। বিমানবন্দরে গিয়ে ফিরতে ইচ্ছুকরা ট্রাভেল পাস নিয়ে সমস্যায় পড়লে সেটিও দ্রুত সমাধান করছে দূতাবাস। হাইকমিশন থেকে ইস্যু করা ট্রাভেল পাসের ছবি বা তথ্য পরিবর্তন করে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।
মালয়েশিয়া থেকে অবৈধ শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে ১৪ ডিসেম্বর থেকে কুয়ালালামপুর-ঢাকা রুটে ১৬টি অতিরিক্ত ফ্লাইট দিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। একই সঙ্গে এ ১৬টি ফ্লাইটে বাংলাদেশ সরকার টিকিটপ্রতি ১২ হাজার টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। এর মধ্যে আগত বাংলাদেশী কর্মীদের প্রতিটি বিমান টিকিটে বাংলাদেশ বিমান ২ হাজার টাকা ছাড় দিচ্ছে। আর ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিল থেকে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে ১০ হাজার টাকা করে। তবে শর্ত হলো, অবশ্যই ট্রাভেল পারমিট থাকতে হবে। এ ভর্তুকির টিকিট বিমানের কুয়ালালামপুরের অফিস থেকে সরাসরি কিনতে হচ্ছে। এজেন্টের কাছ থেকে কেনার সুযোগ দেয়নি বিমান।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে কোনো বাংলাদেশী কর্মীকে ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া। তবে এর আগে ভিসা পাওয়া কর্মীরা সেপ্টেম্বরের পরও মালয়েশিয়া গেছেন। সব মিলিয়ে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় গেছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন।
এর আগে ২০১৭ সালে অবৈধ কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল মালয়েশিয়া সরকার। ওই সময় বৈধ হতে আবেদন করেছিলেন প্রায় ছয় লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক। তবে শেষ পর্যন্ত বৈধ হওয়ার সুযোগ পান ২ লাখ ৮০ হাজার ১১০ জন। সে হিসেবে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ বাংলাদেশী অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। তবে এ সাধারণ ক্ষমার মধ্যেও ধরপাকড় বন্ধ রাখেনি দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশ। প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় চালানো হচ্ছে অভিযান। এসব অভিযানে আটক হওয়ার পাশাপাশি নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) দেশটিতে আটক হয়েছেন প্রায় ৩৬ হাজার অবৈধ অভিবাসী। আটককৃতদের যাচাই-বাছাই শেষে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৮ হাজার ৫৬ জন বাংলাদেশীকে। অন্যদিকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সাধারণ ক্ষমার আওতায় বৈধ হওয়া বা দেশত্যাগের সুযোগ পাওয়ার পরও যারা অবৈধভাবে অবস্থান করবেন, তাদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ।সূত্র-সমকাল
সানবিডি/এনজে