দেশজুড়ে বোরো ধানের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৫ দশমিক ৮৫ টন। যদিও এর পরিমাণ উন্নত জাত ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ হলে ফলন ১১ দশমিক ৭ টনে উন্নীত করা সম্ভব। প্রায় একই হারে ফলন বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে আমন, আউশ, ভুট্টা ও গমের ক্ষেত্রেও। এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না থাকায় সম্ভাব্য ফলনের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ শস্য কম উৎপাদন হচ্ছে। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে না পারার ফলে একদিকে জমির প্রয়োজন পড়ছে বেশি, অন্যদিকে কৃষকের উপকরণ ব্যয় বা উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিট (এফপিএমইউ)শস্যের ফলন বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘মনিটরিং রিপোর্ট-২০১৯ অব দ্য বাংলাদেশ সেকেন্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধানের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার সঙ্গে ফলনের পার্থক্য সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে বোরো ধানে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ৫ দশমিক ৮৫ টন, যা ১১ দশমিক ৭ টনে উন্নীত করা সম্ভব। আমন ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হচ্ছে ৩ দশমিক ৪ টন। এটি ৬ দশমিক ৫ টনে উন্নীত করা সম্ভব। আউশে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হচ্ছে ২ দশমিক ৯ টন, যা ৭ দশমিক ৮ টনে উন্নীত করা সম্ভব। সে হিসেবে বোরোতে উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক, আউশে ৬৩ শতাংশ ও আমনে প্রায় ৪৫ শতাংশই অব্যবহূত থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর এ বিষয়ে জানান, উৎপাদন সক্ষমতা অব্যবহূত থাকার কারণে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। তবে সেটি কমিয়ে আনার জন্য উদ্ভাবনী ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদন সম্ভাবনা ও ফলনের মধ্যকার পার্থক্য ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। গবেষণা ও জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি ধান আবাদ অ্যাগ্রোনমিক প্র্যাকটিস জোরদার করা হচ্ছে। কৃষক পর্যায়ে সঠিক সময়ে সঠিক জাত সঠিকভাবে লাগানো ও পরিচর্যার পদ্ধতিগুলো দ্রুত সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় আবাদ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে শুধু ধান নয়, ভুট্টারও উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৪৪-৪৬ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে না। ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের প্রতিবেদন বলছে, রবি মৌসুমের ভুট্টায় হেক্টরপ্রতি প্রকৃত উৎপাদন হচ্ছে ৬ দশমিক ২ টন। যদিও এটি ১১ দশমিক ৪ টনে উন্নীত করা সম্ভব। খরিপ মৌসুমে ভুট্টার হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৪ দশমিক ৫ টন, যদিও এটি আট টনে উন্নীত করা সম্ভব।
গমের ক্ষেত্রে ফলন অগ্রগতি তুলনামূলক ভালো। যদিও এক্ষেত্রে সক্ষমতার ৪০ শতাংশ অব্যবহূত থেকে যাচ্ছে। সেচ মৌসুমে গমের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ২ দশমিক ৮ টন। এটি ৫ দশমিক ৫ টনে উন্নীত করা সম্ভব। ফলে হেক্টরপ্রতি ফলন পার্থক্য ২ দশমিক ৭ টন। এ মৌসুমে উৎপাদন সক্ষমতা অর্ধেক অব্যবহূত থাকলেও অন্য মৌসুমে সক্ষমতার ভালো ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। রেইনফেড গমের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১ দশমিক ৮ টন, যা সর্বোচ্চ ৩ টনে উন্নীত করা সম্ভব। ফলে এখনো পার্থক্য রয়েছে ১ দশমিক ২ টন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে বোরো ধানের আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। বোরোর আবাদ হয় প্রায় ৫৪-৫৬ লাখ হেক্টর। অন্যদিকে আমন ধানের আবাদ ৪৪-৪৫ লাখ হেক্টর এবং আউশের আবাদ হচ্ছে ৯-১০ লাখ হেক্টর। জমিতে সব মিলিয়ে চালের উৎপাদন ছাড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন। অন্যদিকে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ হেক্টর। উৎপাদন ছাড়িয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টন। এছাড়া গমের আবাদ হচ্ছে চার থেকে সাড়ে চার লাখ হেক্টর। গমের উৎপাদন ১৪ লাখ টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ১০০টির মতো জাত উদ্ভাবন করেছে। তবে এসব জাতের সবই মাঠে প্রয়োগ হচ্ছে না। দেশের অর্ধেকের বেশি জমিতে আবাদ হচ্ছে ধানের পাঁচ-সাতটি জাত। উন্নত জাত না আসা, কৃষক পর্যায়ে আবাদের পরিপূর্ণ পদ্ধতিগুলো অনুসরণ না করা, জাত ও প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে কার্যকরভাবে না পৌঁছানো, ফসলোত্তর ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকীকরণের সম্প্রসারণহীনতার কারণে সম্ভাবনার সঙ্গে ফলনের পার্থক্য বেশি রয়ে গেছে এখনো।
উৎপাদন সক্ষমতার পরিপূর্ণ ব্যবহার না করার কারণে জমির ব্যবহার যেমন বেশি হচ্ছে, তেমনই উপকরণ ব্যয় বা কৃষকের ব্যয়ও বেশি হচ্ছে। দেশের মোট আবাদের প্রায় ৭০ শতাংশই হলো ধানের আবাদ। এ অবস্থায় ফলন পার্থক্য কমিয়ে আনার মাধ্যমে ধানের উৎপাদন বাড়ানো গেলে সেই জমিতে অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদন করা সম্ভব।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আযাদ বলেন, কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন এবং উৎপাদনের সক্ষমতার এখনো পার্থক্য আছে। তবে সেটি আমরা আরো কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। শুধু ধান, গম বা ভুট্টা নয়, অন্য যেসব শস্য রয়েছে সেখানেও ফলন পার্থক্য কমিয়ে আনা হয়েছে। সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন ও তা দ্রুত কৃষকের মাঝে পৌঁছানো হচ্ছে। উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে সার, সেচ ও পেস্ট ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া হচ্ছে। উন্নত বীজের পাশাপাশি যান্ত্রিকীকরণের প্রতি কৃষকদের সহনশীল করে তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি বিপণন ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। একটি কমপ্লিট কর্মসূচি কাজ করছে। সূত্র-বণিক বার্তা
সানবিডি/এনজে