সারাদেশের সবচেয়ে বড় সড়ক নেটওয়ার্ক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি)।বিভিন্ন পর্যায়ে এ সংস্থাটির পাকা সড়কের পরিমাণ ১ লাখ ১৭ হাজার কিলোমিটার। তবে এ সড়কের ৫৩ শতাংশই বেহাল দশায় চলে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা এলজিইডির সড়কের বেহাল দশার পেছনে বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন । এগুলো হচ্ছে বন্যা, নিম্নমানের কাজ ও নির্মাণ উপকরণ, অনিয়ম-দুর্নীতি, অদক্ষ ঠিকাদার, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, নকশার ত্রুটি ও অপ্রতুল বরাদ্দ। তবে মূলত দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ ও অনিয়ম-দুর্নীতিই এলজিইডির বিশাল সড়ক নেটওয়ার্ককে ভঙ্গুর দশায় নিয়ে গেছে বলে মনে করছেন তারা। যদিও এলজিইডির কর্মকর্তারা দায় দিচ্ছেন অপ্রতুল বরাদ্দকে।
এলজিইডি সূত্রে জানিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর সংস্থাটির নেটওয়ার্কের মধ্যে ‘ভালো’ ও ‘চলনসই’ অবস্থায় ছিল ৪৯ শতাংশ সড়ক। এক বছরের ব্যবধানে ২ শতাংশ কমে ‘ভালো’ ও ‘চলনসই’ সড়কের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশে। বাকি ৫৩ শতাংশ সড়কই খারাপ। অর্থাৎ সংস্থাটির প্রায় ৬২ হাজার কিলোমিটার সড়ক খারাপ বা বেহাল অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে নতুন করে বেহাল দশায় গেছে ২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার সড়ক।
এই সংস্থার সড়কগুলো তুলনামূলক নিচু করে নির্মাণ করা হয়। এজন্য বন্যায় সংস্থাটির সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। গত বছরের বন্যায় এলজিইডির প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কিলোমিটার পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়কের বেশির ভাগই এখনো মেরামত হয়নি।
বিদায়ী ২০১৯ সালের বন্যায় কুড়িগ্রামের নয়টি উপজেলায় ১৬৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রৌমারী উপজেলার সড়ক। ওই উপজেলার ২২টি পাকা সড়ক বিভিন্ন জায়গায় ধুয়ে গেছে। আরো কয়েকটি সড়ক দীর্ঘদিন পানিতে ডুবে থাকায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফুলবাড়ী, রাজীবপুর, নাগেশ্বরী, সদর ও উলিপুর উপজেলার সড়কও। এসব সড়ক সংস্কারে অন্তত ৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন এলজিইডি কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আব্দুল আজিজ।
বন্যার পাশাপাশি নিম্নমানের নির্মাণকাজও এলজিইডির সড়কগুলোকে বেহাল দশায় নিয়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ। সম্প্রতি পরিদর্শনকালে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার হিঙ্গলকান্দী-লালপাড়া সড়ক নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছেন এলজিইডির প্রকৌশলীরা। সড়কটি নির্মাণে নিম্নমানের ইট ব্যবহার করেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার।
এলজিইডির সড়ক নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। এমন একটি অভিযোগ উঠেছে বান্দরবান সদর উপজেলার ক্যায়ামলং-কুহালং সড়ক নির্মাণে। ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এলজিইডির প্রকৌশলীদের ‘ম্যানেজ’ করে অর্ধেক বিল আগেই তুলে নেন তিনি। পরে সড়কটিতে নিম্নমানের নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করেছেন তিনি।
সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে এলজিইডির নিজস্ব ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে। ২০০৫ সালে এলজিইডির এ ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড প্রস্তুত করে দেয় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, এলজিইডির নির্মিত সড়কের আয়ুষ্কাল ১০ বছর। সড়কের ভার বহনের ক্ষমতা গাড়িপ্রতি এক্সেলে ৮ দশমিক ২ টন। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরও একই ভার বহনে সক্ষম করে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করে।
তবে ২০০৫ সালে প্রণীত এ ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে করেন এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, যখন ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তখন গ্রামীণ সড়কে খুব বেশি যানবাহন চলত না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। এখন গ্রামীণ সড়কগুলোতেও প্রচুর গাড়ি চলছে। ফলে দ্রুত নষ্ট হচ্ছে সড়ক। এ ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডটি দ্রুত পরিবর্তন করা উচিত বলে মত দেন প্রায় ৩৬ বছর এলজিইডির সঙ্গে কাজ করা এ প্রকৌশলী।
সড়ক নির্মাণে এলজিইডির নিজস্ব ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড থাকলেও গ্রামীণ সড়ক নির্মাণে তার ছিটেফোঁটাও অনুসরণ করা হয় না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, একটা সড়ক নির্মাণের আগে অনেকগুলো বিষয় যাচাই করতে হয়। মাটি পরীক্ষা, গতিপথ নির্ধারণ, চলাচলরত যানবাহনের সংখ্যাসহ বিভিন্ন আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে কিছুই মানা হয় না। ঠিকাদারকে একটা রাস্তার কাজ ধরিয়ে দেয়া হয়। সেখানে ঠিকাদার নিজের খেয়াল-খুশিমতো সড়ক নির্মাণ করেন। নির্মাণকালে যেমন প্রয়োজনীয় তদারকি হয় না, তেমনি নিম্নমানের নির্মাণকাজের কারণে কাউকে জবাবদিহিও করতে হয় না।
এদিকে এলজিইডির কর্মকর্তারা সংস্থাটির সড়ক নেটওয়ার্ক বেহাল দশায় থাকার জন্য মূলত দায়ী করছেন অপ্রতুল বরাদ্দকে। চলতি অর্থবছর সড়ক ও সড়ক অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে এলজিইডি। এ হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি বরাদ্দ দেড় লাখ টাকা।
সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে এলজিইডির বরাদ্দকে খুবই কম বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামও। তিনি বলেন, সওজ অধিদপ্তরের একটি সড়কে যেখানে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, সেখানে আমরা ৫০ লাখও পাই না। রক্ষণাবেক্ষণ খাতের অবস্থা আরো করুণ। এলজিইডির সড়কের একটা বড় অংশ বেহাল দশায় থাকার এটা একটা বড় কারণ।
এলজিইডির সড়কগুলোকে টেকসই করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, আগে গ্রামীণ রাস্তাগুলো নির্মাণ করা হতো বলতে গেলে অপরিকল্পিতভাবে। এখন কিন্তু আমরা গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে বড় পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। কয়েক বছরের মধ্যেই এর সুফল দৃশ্যমান হবে। সূত্র-বণিক বার্তা
সানবিডি/এনজে