জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস মধ্যবিত্তের

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০১-১৩ ১২:৪৭:২৫


দেশে আয় যেভাবে বাড়ছে, তার তুলনায় ব্যয় বাড়ছে তীব্রগতিতে। নিম্নবিত্তের মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পেলেও বাড়তি ব্যয়ের চাপে পিষ্ট মধ্যবিত্তরা। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। নিত্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।

শাকসবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন। একইভাবে বাড়ি ভাড়া, জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ও চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়েছে। কিন্তু ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আয় বাড়ছে না। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমছে।

অনেককে সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পণ্য দাম কমাতে ছিল নানা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এসব শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবতা একেবারে উল্টো।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দাম কমার লক্ষণ নেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, জিনিসপত্রের দাম কমার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং তা আরও বাড়তে পারে। কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়লে তা সরাসরি প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যের ওপর।

গত বাজেটে কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ানোর নানামুখী কর্মসূচি নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো পণ্যমূল্য ও সেবার দাম বেড়েছে। এছাড়া চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে।

সরকারি-বেসরকারি সংস্থার জরিপ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে দেখা গেছে, এক বছরে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিপরীতে আয় বেড়েছে মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশ। ফলে তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার ব্যবধান বেড়েছে গড়ে ৬ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস, নিত্যপণ্য, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত ব্যয় বেশি মাত্রায় বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ এবং পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার বাড়তি ব্যয়। এসব ব্যয় মেটাতে কমে যাচ্ছে সঞ্চয়। নিম্ন আয়ের মানুষ বড় কোনো অসুখ না হলে চিকিৎসা নিচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামনে আরও দুর্দিন আসছে। কারণ প্রতিবার বাজেটের পর বিভিন্ন জিনিসের দাম এমনিতেই বেড়ে যায়।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এতে শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, শ্রমিকদের মজুরি হার বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃত মজুরি কতটা বাড়ছে তা বিবেচনার বিষয়।

অর্থাৎ যেহারে আয় বেড়েছে বাজারে জিনিসপত্রের দাম তার চেয়ে বেশি বেড়েছে। তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু এর সুফল সবার মধ্যে যতটা পৌঁছানোর কথা ততটা পৌঁছানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দারিদ্র্য বিমোচন, মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) যে লক্ষ্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন, সেটি অর্জন সম্ভব হবে কিনা সেক্ষেত্রে একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায়।

ক্যাবের জরিপ : সম্প্রতি ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের ১৫টি পাইকারি ও খুচরা বাজার থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা মূল্য পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে পণ্য ও সেবা মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, এক বছরে আটা ময়দার দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, মাংসের দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ, মুরগির দাম ৬ শতাংশ, মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ। এককভাবে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭২ শতাংশ। এছাড়াও সবজির দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। বর্তমানে ৫০ টাকার কমে কোনো সবজি পাওয়া যায় না।

ক্যাবের জরিপ অনুসারে চায়ের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ, খেজুরের গুড় ৩৯ শতাংশ, তরল দুধ ১১ শতাংশ এবং পোশাক জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ডিসেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ।

এ সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ, নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, বছরজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেশি ছিল। তবে নিত্যপণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, আটা, শাকসবজি, ফল, মসলা, তেল, দুধ ও তামাক জাতীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে।

কেস স্ট্যাডি : ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরিজীবী আশিকুর রহমান আসাদুজ্জামান (৪৩) রাজধানীর ফকিরাপুলের একটি মেসে থাকেন। তার মাসিক আয় ৩২ হাজার টাকা। মেসে তার ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। দুই মেয়ে ইয়াসমিন এবং নিশির নামে ৫০০ টাকা করে এক হাজার টাকার মাসিক সঞ্চয় ছাড়া তার আর কোনো সঞ্চয় নেই।

অথচ গত বছরের একই সময়ে প্রতি মাসে নিরাপত্তার জন্য তার হাতে কিছু টাকা থাকত। এখন বাড়তি খরচ মেটাতে তিনি চিকিৎসা ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বড় কোনো অসুখ না হলে সহজে চিকিৎসকের কাছে তিনি যান না। বিশেষ কোনো সংকট দেখা দিলে গ্রামের জমি বিক্রি করা ছাড়া তার বিকল্প কোনো পথ নেই।

এছাড়া দুই মেয়ে বিয়ে দেয়ার চিন্তা তো রয়েছে। ৪০ হাজার টাকা বেতনে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে চাকরি করেন রেজাউল। থাকেন মতিঝিলের জসীমউদ্দীন রোডে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় তারও সঞ্চয় কমেছে। বেসরকারি একটি স্কুলের শিক্ষক কামরুল জানান, নিত্যপণ্যের দাম বাদে এক বছরে বাসা ভাড়া যত টাকা বেড়েছে সে হারে বেতন বাড়েনি।

তিনি বলেন, অঞ্চলভিত্তিক বাড়িওয়ালাদের সমিতিগুলো ইচ্ছামাফিক বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করছে। কোথাও কোথাও সমিতি ছাড়াও মালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন।

বাড়িভাড়া : অনেকের অভিযোগ, ঢাকায় বছরে দুইবার বাড়িভাড়া বাড়ে। বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারিতে একবার, আর জুনে নতুন বাজেট ঘোষণার পর আরেকবার। এক বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ১২ শতাংশ। গত বছর যে বাড়ির ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকা।

বর্তমানে ওই বাড়ির ভাড়া ১১ হাজার ২০০ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকার ১০টি জোনের মধ্যে তিন স্তরের বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করেছে ডিসিসি। এগুলো হল- মেইন রোডের পাশে, গলির ৩০০ ফুটের মধ্যে এবং গলির ৩০০ ফুটের বাইরে। বাড়ির ক্ষেত্রেও তিনটি স্তর রয়েছে।

এগুলো হল- পাকা, সেমিপাকা ও কাঁচা বাড়ি। পাকা বাড়ির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের সর্বোচ্চ ভাড়া ১০ থেকে ১১ টাকা। এ হিসেবে এক হাজার বর্গফুটের বাসার সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়া উচিত ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমানে এ রকম বাসার ভাড়া ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল : বর্তমান কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

যাতায়াত ভাড়া : বারবার জ্বালানির দাম বাড়ানোর ফলে যানবাহনের ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে। এক বছরে মানুষের যাতায়াত বাবদ ব্যয় ৮ শতাংশ বেড়েছে। যানবাহনের ভাড়া ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের বিনোদন ও ভ্রমণ ব্যয়ও বেড়েছে।

লেখাপড়ার খরচ : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন ও কোচিং সেন্টারের খরচসহ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। লেখাপড়ার খরচের মধ্যে ভর্তি ফি এখন অনেক অভিভাবকের জন্যই বোঝা। একই সঙ্গে স্কুলের বেতন বেড়েছে ব্যাপক হারে। আগে যে স্কুলে বেতন ছিল তিন হাজার টাকা, এখন তা পাঁচ হাজার টাকা হয়েছে। নতুন ভর্তির ক্ষেত্রে ডোনেশনের নামে নেয়া হচ্ছে বাড়তি টাকা।

চিকিৎসা ব্যয় : এক বছর ধরে অব্যাহতভাবে বাড়ছে ওষুধের দাম। একই সঙ্গে চিকিৎসকের ফি, ল্যাবরেটরি টেস্টের খরচ বেড়েছে। ফলে এক বছরে চিকিৎসা ব্যয় ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এছাড়া মানুষের অন্য সব খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ।

অর্থনীতিতে বৈষম্য সীমাহীন : অর্থনীতিতে যে সূচক দিয়ে আয় ও সম্পদের বৈষম্য পরিমাপ করা হয় তাকে বলে গিনি কো-ইফিসিয়েন্ট। ওই সূচক অনুসারে ২০১০ সালে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের আয় ছিল দেশের মোট আয়ের দশমিক ৭৮ শতাংশ।

২০১৬ সালে তা কমে মাত্র দশমিক ২৩ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ২০১০ সালে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয় ছিল মোট আয়ের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬ সালে তা বেড়ে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া শুধু আয় নয়, সম্পদে বৈষম্য আরও বেশি।

২০০৫ সালে নিম্ন শ্রেণির ৫ শতাংশ মানুষের সম্পদ ছিল মোট সম্পদের মাত্র দশমিক ০৬ শতাংশ। ২০১০ সালে তা কমে দশমিক ০৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ২০০৫ সালে উচ্চ শ্রেণির ৫ শতাংশের সম্পদ ছিল মোট সম্পদের ৪৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০১০ সালে তা আরও বেড়ে ৫১ দশমিক ৩২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সূত্র: যুগান্তর
সানবিডি/ঢাকা/এসএস