মসিউল হক চৌধুরী। কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সূচনালগ্ন থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর ব্যাংকটি পার করেছে চার মাস। এ সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন:
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেশী-বিদেশী অনেক ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। এখন আপনার হাতেই একটি ব্যাংকের সূচনা হলো। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কী?
২৭ বছরের চাকরিজীবনে দেশে ও দেশের বাইরে অনেক ব্যাংকে কাজ করেছি। তবে সেসব সুখানুভূতির সঙ্গে কমিউনিটি ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতার তুলনাই চলে না। নতুন একটি ব্যাংকের গোড়াপত্তন করার আনন্দ অন্য রকম। রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া, তিনি আমাকে এ সুযোগ করে দিয়েছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে যা শিখেছি, তার মধ্য থেকে উত্কৃষ্ট অভিজ্ঞতাগুলো এ ব্যাংকে কাজে লাগিয়েছি। ফলে সূচনালগ্নেই কমিউনিটি ব্যাংক একটি শক্ত ভিত্তি পেয়েছে।
যাত্রার চার মাসে কমিউনিটি ব্যাংক কতটুকু এগোল?
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর কমিউনিটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সিবিএসের জন্য চুক্তি করার মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যে আমরা কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছি। দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলো যে সফটওয়্যার ব্যবহার করে, সে কোম্পানির সঙ্গে আমরা চুক্তি করেছি। এরপর দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়ার কার্যক্রমও শেষ হয়। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর কমিউনিটি ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে। সেদিনই ব্যাংকের করপোরেট শাখার কার্যক্রম শুরু হয়। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে এ ব্যাংকের সঙ্গে লক্ষাধিক গ্রাহক যুক্ত হয়েছে। মূলত বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরাই এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রাহক। চলতি মাসের মধ্যেই আমরা পুলিশের বাকি সদস্যদের ব্যাংক হিসাবও খুলে ফেলব। পুলিশ সদস্যরা জানুয়ারি মাসের বেতন ফেব্রুয়ারির শুরুতে পাবে। আশা করছি, এ সময়ের মধ্যেই আমরা হিসাবধারীদের হাতে কমিউনিটি ব্যাংকের চেকবই ও ডেবিট কার্ড পৌঁছে দিতে পারব।
এরই মধ্যে আমরা ‘কমিউনিটি ক্যাশ’ নামে একটি সেলফোন অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছি। এখন পর্যন্ত এ অ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। অ্যাপটি ব্যবহার করে গ্রাহকরা ফান্ড ট্রান্সফার, মোবাইল টপআপসহ গুরুত্বপূর্ণ লেনদেন সম্পন্ন করতে পারবেন।
শাখা না উপশাখা, সম্প্রসারণের জন্য কোনটিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন?
দেশব্যাপী সম্প্রসারণের জন্য আমরা শাখা ও উপশাখা—এ দুটি মাধ্যমকেই বেছে নিতে চাই। এখন পর্যন্ত আমরা কমিউনিটি ব্যাংকের ছয়টি শাখা চালু করেছি। আরো ১২টি শাখা চালু করার অনুমোদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমরা পেয়েছি। চলতি বছরের মধ্যেই এ শাখাগুলো চালু হবে।
এছাড়া ৬৪ জেলায় আমরা ‘সার্ভিস ডেস্ক’ বসাচ্ছি। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব ডেস্ক জেলা পুলিশ লাইনে স্থাপন করা হচ্ছে। ডেস্কে আমরা ব্যাংকের পক্ষ থেকে জনবল দিচ্ছি। পাশাপাশি ডেস্কের সঙ্গেই এটিএম বুথ স্থাপন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ৩৫টি জেলায় এ ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। বাকি জেলাগুলোয়ও দ্রুততম সময়ে সার্ভিস ডেস্ক চালু করা হবে। বেতনের বিপরীতে ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়াও চালু করা হয়েছে। এ ঋণ পণ্য শাখা থেকে সার্ভিস ডেস্ক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবে।
শুধু শাখা খোলার মধ্যেই কমিউনিটি ব্যাংক সীমাবদ্ধ হবে না। বরং উপশাখা ও ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের অন্যান্য সেবা চালুর মাধ্যমে আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে চাই।
কমিউনিটি ব্যাংকের কাঙ্ক্ষিত গ্রাহক কারা?
সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই বেসরকারি খাতের ব্যাংক হিসেবে কমিউনিটি ব্যাংক জায়গা করে নিতে চায়। এজন্য আমরা সাধারণ মানুষের আস্থার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। প্রাথমিকভাবে আমাদের লক্ষ্য হলো পুলিশের সব সদস্যকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা। আগে অনেক পুলিশ সদস্যের বেতন নগদে পরিশোধ করা হতো। এখন তাদের সবার বেতন-ভাতা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে।
ফলে কমিউনিটি ব্যাংকের যাত্রাই হচ্ছে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে। একটি ব্যাংক চালু হওয়ার এক বছরের মধ্যেই দুই লাখ গ্রাহক পাওয়া উল্লেখযোগ্য অর্জন। এটি প্রশংসা পাওয়ার মতোই একটি কাজ। পুলিশ সদস্যদের ব্যাংক হিসাব চালু করার পর আমরা তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের ব্যাংক হিসাব চালুর উদ্যোগ নেব। আর এভাবে প্রতি বছর ব্যাংকের হিসাব সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি আমরা।
সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছানোর জন্য আপনাদের কর্মসূচি কী?
‘আস্থা, নিরাপত্তা ও প্রগতি’—এটি কমিউনিটি ব্যাংকের স্লোগান। ব্যাংকের যাত্রার প্রথম দিন থেকেই আমরা করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করেছি। স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে পথচলা আমাদের লক্ষ্য। আমরা জনগণকে এ বার্তা দিতে চাই যে তাদের প্রতিটি অর্থ কমিউনিটি ব্যাংকে নিরাপদ থাকবে। যুগোপযোগী ব্যাংকিং সেবা ও পণ্য নিয়ে আমরা গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে চাই। উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারলে সাধারণ মানুষ নিজ থেকেই কমিউনিটি ব্যাংকে আসবে। শাখা স্থাপনের ক্ষেত্রেও আমরা গণমানুষের কাছে থাকার বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কী?
প্রযুক্তির উত্কর্ষের কারণে প্র্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন আসছে। সব ধরনের সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। উবার বা অ্যামাজনের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছাচ্ছে। ফলে ১০ বছর পর ব্যাংকিং সেবার রূপ বা ধরন কী হবে, সেটি এখন কল্পনাই করা যাচ্ছে না।
সেজন্য যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রস্তুতি নিয়েই আমরা সামনে এগোতে চাই। ব্যাংকের ভিত যদি শক্ত হয়, তাহলে যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়া সম্ভব। আপাতত আমরা রিটেইল ও করপোরেট ফিন্যান্স শুরু করছি। তবে সেটি অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছি, যাতে খেলাপি ঋণের কোনো অভিঘাত আমাদের সইতে না হয়। কমিউনিটি ব্যাংক এডি লাইসেন্স পেয়েছে। শিগগিরই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কাজও আমরা শুরু করব। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর সব ধরনের পণ্য আমাদের থাকবে। এর বাইরে কমিউনিটিভিত্তিক কিছু কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। অগ্রযাত্রায় এখন পর্যন্ত যে অর্জন তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
চার মাসেই অগ্রযাত্রায় কমিউনিটি ব্যাংকের অর্জন ঈর্ষণীয়। এরই মধ্যে কমিউনিটি ব্যাংকের আমানত ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ সময়ে আমরা ঋণও বিতরণ করেছি। ব্যাংকের এডি রেশিও (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) প্রায় ২৫ শতাংশ। আমাদের কর্মীসংখ্যা এখন আড়াই শতাধিক। এ বছরই তা ৫০০ ছাড়াবে।
একটি স্বচ্ছ ও যোগ্য পরিচালনা পর্ষদের অধীনে কমিউনিটি ব্যাংক পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের আইজি এ ব্যাংকের পর্ষদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পুলিশের শীর্ষস্থানীয় অন্য কর্মকর্তারাও কমিউনিটি ব্যাংক পর্ষদের সদস্য।
এছাড়া অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও শিক্ষক এ ব্যাংকের পর্ষদকে সমৃদ্ধ করেছেন। যাত্রার প্রথম দিন থেকেই কমিউনিটি ব্যাংক করপোরেট সুশাসন পরিপালন করে এগিয়েছে। সব মিলিয়ে এ ব্যাংকের মাত্র চার মাসের অর্জন হলো, দীর্ঘ পথচলার শক্ত ভিত তৈরি করতে পারা। সূত্র: বণিক বার্তা
সানবিডি/ঢাকা/এসএস