কিশোরগঞ্জ জেলার করিমপুরের আবুল কালামের ছেলে মো. শোয়েব আহম্মেদ। এক সন্তানের জনক শোয়েব আহম্মেদ সৌদি আরবের রিয়াদে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। ১২ বছর ধরে তিনি ভালোই উপার্জন করছিলেন এবং দোকানে কোটি টাকার মালামালও ছিল। সপ্তাহখানেক আগে কফিলকে (মালিক) দুই লাখ টাকা এবং দোকানের অগ্রিম তিন লাখ টাকাও দিয়েছিলেন। তিনি জানান, তাঁর কাগজপত্রসহ সব কিছু ঠিক থাকার পরও সৌদি পুলিশ তাঁকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং কোনো কথা না শুনেই দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
শোয়েব আহম্মেদ বলেন, ‘সৌদি আরবে প্রবাসীরা এখন ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভিসাসহ সব ডকুমেন্ট থাকার পরও আমাকে জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানে কাপড়ের ব্যবসা করতাম। ওই দোকানে আমার কোটি টাকার মালামাল ছিল, কিছুই আনতে দেয়নি, এক কাপড়েই দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
আরেক করুণ অবস্থা টাঙ্গাইলের মির্জাপুর বহরিয়া গ্রামের মল্লিক আতাউর রহমানের ছেলে মোস্তফা মল্লিকের। বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ঋণ এবং মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায় সৌদিতে গিয়ে ছয় মাস থাকতে পারেননি। আকামাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার পরও তাঁকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মল্লিক বলেন, ‘দালাদের মিষ্টি কথায় ভুলে গেলাম সৌদি আরব। ঋণের টাকায় বিদেশে গিয়ে বেশি দিন থাকতে পারিনি, সৌদি পুলিশ ধরেই সরাসরি দেশে পাঠিয়ে দেয়। এখন দুই কন্যাসন্তানের মুখে খাবার দিব নাকি ঋণ শোধ করব—কিছুই হিসাব মেলাতে পারছি না।’
জানা গেছে, ভিসার মেয়াদ থাকাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তাঁরা বৈধ নাকি অবৈধ কোনো কিছুই দেখছে না দেশটির পুলিশ। প্রবাসী ধরলেই নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত শনিবার দেশটিতে অবস্থানরত টাঙ্গাইলের কালীহাতি উপজেলার কোনাবাড়ী গ্রামের রইসউদ্দিন মিয়ার ছেলে সালাউদ্দিন মিয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। তিনি থাকেন সৌদির দাম্মাম এলাকায়। সালাউদ্দিন বলেন, ‘সৌদি আরবে হাজার হাজার প্রবাসী ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, পুলিশের গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেকেই এখন বাড়ি থেকেই বের হচ্ছে না। পুলিশ যাকেই পাচ্ছে তাকেই ধরে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে, বৈধ আর অবৈধ দেখছে না। আমার সঙ্গের নরসিংদীর দুজন এবং শরীয়তপুরের একজন তিন মাস হলো সৌদি আরব এলেও ধরা পড়ায় দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। ভয়ে আমিও বাড়ি থেকে বের হচ্ছি না।’
গত শনিবার এক দিনেই সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ২২৪ জন বাংলাদেশিকে। দুটি ফ্লাইটে তাঁরা খালি হাতেই দেশে ফেরেন। তাঁদের চোখে-মুখে ছিল বিষাদ আর অনিশ্চয়তার ছাপ। বেশির ভাগই ফিরেছেন শূন্য হাতে, অনেককে আকামা থাকার পরও দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের দিন শুক্রবার একইভাবে খালি হাতে ফিরেছেন ১০৯ জন। ৭ জানুয়ারি ফেরেন পাঁচ নারীকর্মীসহ ১৩২ জন প্রবাসী শ্রমিক। এ নিয়ে চলতি বছরের ১৮ দিনে এক হাজার ৮৩৪ জন বাংলাদেশি সৌদি আরব থেকে ফিরলেন। যাঁরা ফিরলেন তাঁদের অনেকেই ধারদেনা করে বা শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে দেশটিতে গিয়েছিলেন। বেশির ভাগ লোককেই যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই ফিরতে হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালে ২৫ হাজার ৭৮৯ বাংলাদেশিকে সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৬৪ হাজার ৬৩৮ কর্মী দেশে ফিরেছেন। সৌদি আরব থেকে ২৫ হাজার ৭৮৯, মালয়েশিয়া থেকে ১৫ হাজার ৩৮৯, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ছয় হাজার ১১৭, ওমান থেকে সাত হাজার ৩৬৬, মালদ্বীপ থেকে দুই হাজার ৫২৫, কাতার থেকে দুই হাজার ১২, বাহরাইন থেকে এক হাজার ৪৪৮ ও কুয়েত থেকে ৪৭৯ জন শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন।
ফেরত আসাদের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহযোগিতায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রগ্রাম থেকে জরুরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। গতকাল দেশে ফেরা বরিশাল জেলার আগৈলঝারা উপজেলার শামিম (৩০) জানান, মাত্র তিন মাস আগে তিন লাখ টাকা খরচ করে তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন ড্রাইভিং ভিসা নিয়ে। সেখানে দুই মাস কাজ করলেও কোনো বেতন পাননি। পরে মালিককে (কফিল) বারবার অনুরোধ করলে তিনি অন্য জায়গায় কাজের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু সেখানে কর্মরত অবস্থায় পুলিশ তাঁকে আটক করে। এ সময় তিনি মালিককে ফোন দিলেও তিনি দায়িত্ব নেননি।
একই অবস্থা নরসিংদীর মো. মিন্টু মিয়ার। চার লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ মাস আগে ক্লিনারের কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। দিনের কাজ শেষে রুমে ফেরার সময় পুলিশ তাঁকে আটক করে। আকামা দেখানোর পরও তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পটুয়াখালীর শাহিন সরদার, ময়মনসিংহের মো. আশরাফুল, মো. সুমন ও শফিক, নরসিংন্দীর সালাউদ্দিন, মানিকগঞ্জের আমিনুল, মুন্সীগঞ্জের মামুন কবিরসহ অনেককেই সৌদি যাওয়ার এক বছরের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ফেরত আসা প্রবাসীদের অভিযোগ, তাঁদের প্রত্যেককে নানা স্বপ্ন দেখিয়েছিল দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সির লোকজন। কিন্তু সৌদি আরবে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়েন তাঁরা। অনেকে বেতন পাননি। অনেকে সৌদি আরবে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে ফেরত এসেছেন। তাঁরা সবাই ভবিষ্যত্ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় আছেন। তিনি বলেন, ‘কেউ যখন বিদেশে যান তখন পরিবার-স্বজন সবাই খুশি হন। কিন্তু ফেরত আসার পর তাঁদের পাশে সেভাবে থাকেন না। এমনকি পরিবারের সদস্যরাও তাঁদের নানা কটু কথা বলেন। অথচ এ সময় তাঁদের পাশে সবার দাঁড়ানো উচিত। ফেরত আসা প্রবাসীদের আমরা শুধু বিমানবন্দরে সহায়তা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছি না, তাঁরা যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সে জন্য কাউন্সেলিং, দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও আর্থিকভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করছি। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সবাই মিলে কাজটি করতে হবে। পাশাপাশি এভাবে যেন কাউকে শূন্য হাতে ফিরতে না হয় সে জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিকে দায়িত্ব নিতে হবে। দূতাবাস ও সরকারকেও বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা বন্ধ করা উচিত।’সূত্র-কালের কন্ঠ
সানবিডি/এনজে