এশিয়ার ক্ষুদে ধনী দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরে সাধারণত কখনো বিক্ষোভ হতে দেখা যায় না।কিন্তু হঠাৎ করেই গত নভেম্বরে স্থানীয় একটি পার্কে অভিবাসন নীতির প্রতিবাদে শোভাযাত্রা করেন ৩০০-৪০০ জন সিঙ্গাপুরিয়ান নাগরিক। তাদের অভিযোগ, অতিরিক্ত অভিবাসীর ফলে সিঙ্গাপুরে সম্পত্তির দাম ও জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গেছে। চাকরি, বাসস্থান এমনকি সন্তানদের স্কুলের জন্যও সিঙ্গাপুরিয়ানদের অভিবাসীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে।
স্থানীয়দের মধ্যে ‘অ্যান্টি ফরেনার’ মনোভাবের কারণে অভিবাসীদের জন্য ক্রমেই অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে সিঙ্গাপুর। পরিস্থিতি প্রতিকূল মনে হওয়ায় এরই মধ্যে পরিবার নিয়ে দেশটি ছাড়তে শুরু করেছেন সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়া বিভিন্ন দেশের উচ্চবিত্তরা। দেশটিতে অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পাশাপাশি হোটেল ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশীদের। এমনকি ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ব্যবসায়ীর তালিকায়ও রয়েছেন একজন বাংলাদেশী।
‘অ্যান্টি ফরেনার’ মনোভাব ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সিঙ্গাপুর ছাড়ছেন বাংলাদেশী শ্রমিকরাও। প্রতিকূলতার মধ্যে এখনো যেসব বাংলাদেশী দেশটিতে রয়ে গেছেন, প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম বেতনে কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরিয়ানদের ক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছে গত অক্টোবরে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওর মাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা গেছে, বয়োজ্যেষ্ঠ একজন সিঙ্গাপুরিয়ানকে লাঞ্ছিত করেছেন জন্মসূত্রে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব পাওয়া ভারতীয় অভিবাসী রামেশ এরমালি। বয়োজ্যেষ্ঠ সিঙ্গাপুরিয়ান ওই ভারতীয় অভিবাসীর কনডোমিনিয়াম কমপ্লেক্সের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন।
সম্প্রতি এশিয়ান রিভিউ নিকিতে দেয়া সাক্ষাত্কারে সিঙ্গাপুরিয়ানরা অভিযোগ করেন, স্থানীয়রা জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করছেন, সরকারি বরাদ্দকৃত বাসায় থাকছেন, গ্রাব চালাচ্ছেন। অন্যদিকে বিদেশীরা অত্যাধুনিক কনডোমিনিয়ামে থাকছেন। এ কারণে সিঙ্গাপুরিয়ানদের মধ্যে ‘অ্যান্টি ফরেনার’ মনোভাব বাড়ছে।
নিকির ওই প্রতিবেদন বলছে, সিঙ্গাপুরে দক্ষতার অভাবে স্থানীয়রা বেকার থাকছেন। গত বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দেশটিতে বেকারত্বের হার ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ, যা গত সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণেরও বেশি। গত সেপ্টেম্বরে দেশটিতে ৭৪ হাজার ২০০ অধিবাসী বেকার ছিলেন। স্থানীয়দের বেকারত্ব নিয়ে চিন্তিত দেশটির সরকার। যদিও এ বছর স্থানীয়দের জন্য আরো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে জোর দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ ও আর্থিক সেবা খাতের সম্প্রসারণের ফলে সিঙ্গাপুরের উৎপাদনমুখী শিল্প এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোয় মধ্যম সারির চাকরির (মিড লেভেল জব) প্রয়োজনীয়তা হারাচ্ছে। যতটুকু দরকার তা-ও আবার তরুণ বিশেষ করে কম বেতন হওয়ায় অভিবাসীদের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। এ ধারায় গত প্রান্তিকে যেসব সিঙ্গাপুরিয়ান চাকরি হারিয়েছেন তার তিন-চতুর্থাংশই ছিল প্রফেশনাল, ব্যবস্থাপক, এক্সিকিউটিভ ও টেকনিশিয়ান।
মন্দার কারণে সিঙ্গাপুরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সরকারি জরিপ অনুযায়ী, দেশটিতে আয়ের দিক থেকে নিচের সারিতে থাকা অন্তত ২০ শতাংশ পরিবার ব্যয়ের তুলনায় ৩৩৫ ডলার (সিঙ্গাপুর) কম আয় করছেন। ২০১৭ সালের তুলনায় পানির বিল বেড়েছে ৩০ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়েছে অন্তত ১০ শতাংশ।
সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি ছিল ২০১৯ সালে, মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, ২০২০ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডিবিএস অবশ্য বলছে, প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বছরজুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধকে এর বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া বৈশ্বিক ইলেকট্রনিকস খাতের ধীরগতির ওঠানামা আরো একটি বড় কারণ।
অর্থনীতির এমন মন্দা পরিস্থিতিতে বিদেশীদের অবস্থান মোটেও সহ্য করতে পারছেন না সিঙ্গাপুরিয়ানরা। এ কারণেই দেশটিতে সরকারের অভিবাসন নীতির বিরোধিতা এখন তুঙ্গে। অভিবাসন নীতি অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ৬৯ লাখে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটির সরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়তি জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই হবে অভিবাসী।
প্রসঙ্গত, ২০০০ সালে সিঙ্গাপুরে অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৫৫ হাজার। ২০১০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ১৩ লাখে দাঁড়ায়। এ পরিসংখ্যানের বাইরে আরো বিদেশী রয়েছেন, যারা সিঙ্গাপুরে জন্মগ্রহণ সূত্রে নাগরিকত্ব পেয়েছেন। আর ২০১৯ সালের জুনে সিঙ্গাপুরের মোট যে জনসংখ্যা হিসাব করা হয়েছে, তাতে নাগরিক রয়েছেন ৩৫ লাখ। আর স্থায়ী বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত ৫ লাখ ৩০ হাজার এবং বিদেশী শ্রমিক ও ছাত্রের সংখ্যা ১৭ লাখ।
বিনিয়োগের মাধ্যমে গত এক দশকে সিঙ্গাপুরে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন বহু বাংলাদেশী। এ তালিকায় রাজনীতিবিদ, ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্সের মালিক, মাঝারি ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারাও। বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও পরিচালকের অফিসও রয়েছে সিঙ্গাপুরে।
তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি ‘অ্যান্টি ফরেনার’ মনোভাবের প্রভাবে এরই মধ্যে দেশটি ছাড়তে শুরু করেছেন অনেক সচ্ছল বাংলাদেশী। বেসরকারি ব্যাংকের একজন সাবেক চেয়ারম্যান পরিবারসহ দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে বসবাস করে এলেও সম্প্রতি তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে গেছেন। একইভাবে অন্য এক ব্যাংকের পরিচালক সম্প্রতি সিঙ্গাপুর থেকে পরিবারসমেত দেশে ফিরে এসেছেন।
জানা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ধনী দেশ সিঙ্গাপুরে কাজ করছেন প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশী। একসময় সিঙ্গাপুরে দক্ষ হিসেবে বাংলাদেশী শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা ছিল। দেশটিতে বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি নির্মাণ খাত, ইলেকট্রিক, জাহাজ শিল্পে। এছাড়া বিভিন্ন দোকানের সেলসম্যান হিসেবেও কাজ করছেন প্রচুর বাংলাদেশী। তবে গত এক বছরে মন্দার কারণে অসংখ্য বিদেশী শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে দেশটি।
সিঙ্গাপুরের অবকাঠামো খাতই দেশটির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছে। আর এজন্য দেশটিকে প্রচুর বিদেশী শ্রমিকের ওপর নির্ভর করতে হয়। দেশটির জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের জুনের এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও চীন থেকে ৩ লাখ ৭০০ শ্রমিক দেশটির নির্মাণ শিল্পে নিয়োজিত। যদিও সিঙ্গাপুরে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে নির্মাণ ও মেরিন সেক্টরসহ অনেক কোম্পানি থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও চীনের শ্রমিকরাও। মন্দা কাটাতেই কোম্পানিগুলো নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠায় তাদের।
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক ড. সিআর আবরার বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থনৈতিক মন্দা ছাড়াও টেকনোলজি পরিবর্তনের কারণেও চাকরির ধরন বদলেছে। যার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান কম ম্যানপাওয়ার নিয়ে কাজ চালাতে চায়। সিঙ্গাপুরও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের উচিত দক্ষতা বাড়িয়ে মিড লেভেলের চাকরির জন্য জনশক্তি রফতানিতে জোর দেয়া এবং পাশাপাশি নতুন নতুন দেশে শ্রমবাজার খোঁজা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান ৪৯ হাজার ৮২৯ জন। এছাড়া ২০১৮ সালে ৪১ হাজার ৩৯৩, ২০১৭ সালে ৪০ হাজার ৪০১, ২০১৬ সালে ৫৪ হাজার ৭৩০ এবং ২০১৫ সালে ৫৫ হাজার ৫২৩ জন বাংলাদেশী শ্রমিক সিঙ্গাপুরে গিয়েছেন। সূত্র- বণিক বার্তা
সানবিডি/এনজে