সরকারিভাবে ভর্তুকি দেয়ার কারণে এবছর কৃষিজাত ফসলের ফলন ভালো হয়েছে। এখন শুধু চাল বা ধান নয়, উৎপাদন বেড়েছে বিভিন্ন প্রকার ডাল, তেলবীজসহ আম, নারিকেল, ভুট্টার। এছাড়া চাষ করা হচ্ছে নতুন নতুন জাতের ফসল। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের নজরদারি ও কৃষিবিদদের গবেষণা এই সফলতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, উৎপাদন বাড়লেও পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। বাম্পার ফলন হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সার, সেচ কাজে ডিজেল বরাদ্দ, বিদ্যুৎ ও কৃষি উপকরণ খাতে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকিবাবদ অর্থ রাখা হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধানের উৎপাদন খরচ কমাতে সেচকাজে ডিজেল ব্যবহারে দেড়শ’ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের নেওয়া কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ২০০৮-০৯ অর্থবছর হতে এ পর্যন্ত ৯৬০ কোটি ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ৪৪ জন কৃষক উপকৃত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩৩ কোটি ১৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ধারাবাহিকতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দানাদার (ধান, চাল, গম, ভুট্টা ইত্যাদি) খাদ্যশস্যের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪১৫ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে মোট ৪৩২ লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। চাল ছাড়াও ভুট্টা উৎপাদন বেড়েছে।
সূত্র আরও জানায়, গত অর্থবছরে সবজি উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার টন। যা বিশ্বে তৃতীয়। আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম বাংলাদেশ। গত অর্থবছর দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ মেট্রিক টন। আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেঁয়ারা উৎপাদনে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ৫৩ লাখ ৫৪ হাজার ৮০২ মেট্রিক টন নারিকেল, তাল, খেজুর ও সুপারি চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছে। মাল্টা, রামবুতান, ড্রাগন প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের অপ্রচলিত ও বিদেশি ফল চাষে উৎসাহ প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, গত অর্থবছরে দেশে সম্প্রসারিত সেচ এলাকার আওতায় রয়েছে ২২ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমি। সরবরাহকৃত সেচ যন্ত্র ৫৪৭টি এবং বসানো হয়েছে সোলার প্যানেলযুক্ত ৯৫টি সেচযন্ত্র। ৪৮০টি সেচ অবকাঠামো, ৫৮১ কিলোমিটার খাল-নালা খনন ও পুনর্খনন করা হয়েছে। ৬৮২ কিলোমিটার ভূ-গর্ভস্থ (বারিড পাইপ) সেচনালা এবং ৮ কিলোমিটার ভূ-উপরিস্থ সেচনালা, ২৪ কিলোমিটার গাইড বা ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার আওতায় সৌরবিদ্যুৎচালিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুপেয় পানির ব্যবস্থাকরণ ও সেচ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ১০০ টি পাতকুয়া স্থাপন করা হয়েছে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে দেশের হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় কৃষকের জন্য ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ হারে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩২২ কোটি ৮০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতিমালা ২০১৯ চূড়ান্ত করা হয়েছে, যাতে বিনা সুদে কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে ঋণের ব্যবস্থা থাকবে।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির সোহাগদল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ জানিয়েছেন, ইউরিয়া, পটাশ, টিএসপি ও ডিএপি (ফসফেট) সার ও সেচের বৈদ্যুতিক বিল পরিশোধের মাধ্যমে ভর্তুকির টাকা খরচ করা হচ্ছে। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। সরকারি এই সুবিধার ফলে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। তবে কৃষকরা যে ন্যায্য দাম পায় না এমন অভিযোগও সঠিক।
ময়মনসিংহ সদরের রহমতপুর এলাকার কৃষক জমসেদ বেপারি বলেন, ‘ফলন ভালো হয়েছে। তবে আমরা ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। রোপা আমন মৌসুমে এক একর জমিতে ধান আবাদ করতে খরচ হয়েছিল ২৪ হাজার টাকা। ধান পেয়েছিলাম ৩২ মণ। প্রতিমণ ধান সাড়ে ৬০০ টাকা করে বিক্রি করে পেয়েছি ২০ হাজার ৮০০ টাকা। উৎপাদন খরচ তো ওঠেনি উল্টো লোকসান গুনতে হয়েছে ৩২০০ টাকা।’
নীলফামারী সদরের উত্তর হাড়োয়া সরকার পাড়া গ্রামের কৃষক মোকছেদ আলী বলেন, কয়েক দফা বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা জমিতে আগাম জাতের ভুট্টার আবাদ করছেন। ধানের দাম পতনের কারণেই প্রতি বছরই কৃষকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পেয়ে ভুট্টার চাষ করা হয়েছে। আশা করছেন ভালো ফলন পাবেন। পাবো। কিন্তু ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, সরকারের উদ্যোগ, মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং এবং কৃষকের উদ্যম এই সাফল্য এনেছে। ধানের পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনেও বিশ্বে নজরকাড়া সফলতা আনবে এবং বর্তমানের অবস্থানকে ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি আরও জানান,কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত দাম না পেয়ে পুরোপুরি লোকসানে পড়ছেন–এমন অভিযোগ ঠিক নয়। কৃষিতে সরকারের ভর্তুকি দেওয়ায় কৃষকের ফসলের উৎপাদন খরচ এমনিতেই কমে যায়। কারণ বীজ, সার, কীটনাশক, সেচের পানি ও বিদ্যুৎবিল সরকারের ভর্তুকি থেকে পরিশোধ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও সরকার তো প্রতিবছরই সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান ও চাল কিনছে যাতে কৃষক লাভবান হয়। কারণ, সরকারের নির্ধারিত দাম বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এ ছাড়াও কৃষক যাতে তার উৎপাদিত ফসলের ন্যয্য দাম পায় সেজন্য দেশের কৃষিপ্রধান এলাকায় বিশেষায়িত গোডাউন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল গুদামজাত করে পরবর্তীতে বাজারে ছাড়ার সুযোগ পায়। ফলে কৃষক উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না এমন অভিযোগ সঠিক নয়।
সানবিডি/এনজে