বাংলাদেশের বিভিন্ন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ও রফতানিকারকরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে হাতে হাতে জিএসপি সনদ নিয়ে এতদিন ইউরোপের বাজারে রফতানি করে আসছিলেন। তবে সম্প্রতি রেজিস্টার্ড এক্সপোর্টার (রেক্স) শীর্ষক একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে শুরু করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। যার আওতায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে একটি স্বতন্ত্র ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরের (টিআইএন) বিপরীতে একটি করে রেক্স নম্বর নিতে হবে। যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান নিজেই জিএসপির আবেদন করে সুবিধার অনুমোদন নিতে পারবে। কিন্তু এ প্রক্রিয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
জানা গেছে,টিআইএন’র কারনে রেক্স ব্যবস্থা প্রণয়নের শুরুতেই নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে রফতানিকারকদের। দেশে অনেক গ্রুপ অব কোম্পানিজ আছে, যেগুলোর স্বতন্ত্র টিআইএন একটি। এই একটি নম্বরই ব্যবহার করে আসছিল গ্রুপের আওতায় অন্যান্য ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানও। কিন্তু রেক্সের নিয়ম অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র টিআইএনের বিপরীতে একটি রেক্স নম্বর ইস্যু হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গ্রুপের আওতায় থাকা অন্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জিএসপি সুবিধার আবেদন করতে পারছে না। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলছে, স্বতন্ত্র টিআইএন ছাড়া রেক্সের আওতায় আবেদন করা জিএসপি সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
সূত্রমতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহযোগিতায় এতদিন একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজের আওতায় থাকা সব প্রতিষ্ঠান একটি মাত্র স্বতন্ত্র টিআইএন নম্বর ব্যবহার করে আসছিল। কিন্তু রেক্সের আওতায় জিএসপি সুবিধা পেতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে রফতানিকারকদের। এ জটিলতার বিষয়ে রফতানি খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ইপিবির সঙ্গেও আলোচনা করেছেন রফতানিকারকরা। সেসব আলোচনায় স্বতন্ত্র টিআইএন নিতে তাগিদের পাশাপাশি রেক্সের আওতায় আসার সময়সীমা বৃদ্ধির বিষয়েও অবহিত করা হয়েছে রফতানিকারকদের।
ইপিবি সূত্র জানিয়েছে, প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে রেক্সের আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১২০০ প্রতিষ্ঠান এসেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবেদন করতে পারছে না স্বতন্ত্র টিআইএন নম্বর না থাকার জটিলতার কারণে। এ জটিলতা নিরসনে ২২ জানুয়ারি এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ রফতানিসংশ্লিষ্ট নয়টি সংগঠনকে চিঠি দিয়েছে ইপিবি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, একটি টিআইএন নম্বরের বিপরীতে গ্রুপভুক্ত বা ব্যক্তিমালিকানাধীন একাধিক প্রতিষ্ঠানকে রেক্স নম্বর প্রদান উদ্ভূত জটিলতা নিরসনের জন্য ৭ জানুয়ারি একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলোচনা হয় যে গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের একটি টিআইএন নম্বরের আওতায় একাধিক প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত আছে। এসব প্রতিষ্ঠান একটি টিআইএন ব্যবহার করে পৃথক পৃথকভাবে রেক্স নম্বর বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইটি ব্যবস্থায় গ্রহণীয় নয়। কারণ ইইউ আইটি ব্যবস্থা একটি মৌলিক নম্বরের বিপরীতে একটি রেক্স নিবন্ধন নম্বরের বিধান রয়েছে।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, গ্রুপভুক্ত বা ব্যক্তিমালিকানাধীন একাধিক প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন এবং ট্রেড আইডেনটিফিকেশন নম্বরের কপিতে প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ থাকে। সেখানে ইউনিট বা অন্যান্য গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ থাকে না। কোনো কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানের রেক্স নিবন্ধন রিভোকেশন বা বাতিলের মতো পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানের নামকেই রিভোক করতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানের জিএসপি সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
রেক্স ব্যবস্থার আওতায় নিবন্ধন না নিলে বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি পাবে না বাংলাদেশের পাঁচ সহস্রাধিক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। ইইউর বাজারে জিএসপি সুবিধা পেতে এতদিন পণ্যের বৃত্তান্ত উল্লেখের মাধ্যমে কান্ট্রি অব অরিজিন সনদ নিতে হতো ইপিবির কাছ থেকে। নির্দিষ্ট ফরম পূরণের পর পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন ঘোষণা নিশ্চিতের মাধ্যমে সনদটি প্রদান করত ইপিবি। তবে নতুন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় রফতানিকারক নিজেই পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন ঘোষণা করবে।
ইপিবি-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যদিও সব খাত মিলিয়ে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ১৫ হাজার। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানির জন্য সব খাত মিলিয়ে বাংলাদেশের পাঁচ থেকে ছয় হাজার সক্রিয় প্রতিষ্ঠান ইপিবি থেকে জিএসপি সনদ নিচ্ছে। ইপিবির নিবন্ধিত রেক্স ব্যবস্থার আওতায় আসা এ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই নিজেদের জিএসপি সনদ দেবে। এ ব্যবস্থাটি নজরদারি করবে ইপিবি। এ নজরদারি ব্যবস্থাটি নিশ্ছিদ্র করার কাজ চলছে।
ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো প্রসঙ্গে ইপিবি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, জিএসপি জালিয়াতির ঘটনা বাংলাদেশে এর আগে ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ সূত্রগুলো বলেছে, বাংলাদেশের একজন রফতানিকারক জিএসপি সনদ ইস্যু করার পর পণ্যটি বাংলাদেশ থেকে না পাঠিয়ে পাঠানো হয়েছে চীন থেকে। এতে করে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করে জিএসপি সুবিধাটি পেয়েছে চীন। কিন্তু শুল্ক সুবিধা ইইউ চীনকে দিচ্ছে না। ফলে চীন থেকে ইইউর যে রাজস্ব আয় হতো তা হয়নি। এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা এড়াতে রেক্স ব্যবস্থায় কঠোর দায়িত্ব নিতে হবে ইপিবিকে, যাতে করে জিএসপির অপব্যবহার না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
প্রসঙ্গত, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিশ্বব্যাপী রফতানি করেছে। মোট রফতানির ৬০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে।
সানবিডি/এনজে