মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ও ফল প্রশ্নবিদ্ধ
আপডেট: ২০১৫-০৯-২১ ১৬:৩০:২১
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যখন সংবাদ সম্মেলন করে পরীক্ষা স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হওয়ার দাবি করছে, তখন মেডিকেল কলেজে ভর্তির ‘ফাঁস’ হওয়া প্রশ্ন ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর চলমান অভিযোগের মধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল রোববার দুপুরের আগেই অনেকটা তড়িঘড়ি করে ভর্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করল।
অবশ্য এ ফলকে এবার ‘ভালো’ বলে দাবি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, ছেলেমেয়েরা এবার খুব পড়ালেখা করেছে।
এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে রাজধানীসহ দেশের কমপক্ষে আটটি জেলায় গতকাল সকাল থেকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন, মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন।
মেডিকেলে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে গতকাল হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন আইনজীবী মো. ইউনূছ আলী আকন্দ। চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা বলেছেন, তাঁরাও মনে করেন, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ফল প্রকাশ ও নম্বরের বাড়াবাড়ি দেখে। পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন ও বিএনপি এবং ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। তবে সরকার-সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) পরীক্ষা ‘সুষ্ঠুভাবে’ সম্পন্ন করায় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
এর মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ইউজিসির সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজকে সাময়িক বরখাস্তের পর এখন তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে।
মেডিকেলে ভর্তির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গত শুক্রবার সকাল ১০টায়। ফল প্রকাশ শুরু হয় গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে। এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর উঠেছে ৯৪ দশমিক ৭৫। আর সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে সর্বনিম্ন নম্বর ৭৭ দশমিক ৪।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, ৮০ থেকে ৯০ নম্বর পেয়েছেন দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। গত বছর সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ৮১ দশমিক ৫০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাসুদেব কুমার পাল বলেন, ‘আমার বোন ১০০ নম্বরের মধ্যে ৭৩ পেয়েছে, তার অবস্থান চার হাজার সাত শর পর।’
ঢাকা, যশোর ও রংপুর থেকে কমপক্ষে তিনটি নমুনা প্রশ্ন পাঠিয়েছেন ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরা। তাঁরা বলছেন, এ প্রশ্নগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনিময় হয়েছে পরীক্ষার আগের রাত দেড়টা থেকে পরীক্ষার দিন সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত। এর মধ্যে রংপুর থেকে একটি নমুনা প্রশ্ন ই-মেইলে পাঠান এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, পরীক্ষা কেন্দ্র রংপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বাইরে এক অভিভাবক এ প্রশ্নটি হাতে করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর অভিভাবকটি তাঁর হাতে থাকা প্রশ্ন মিলিয়ে নেন। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে ওই প্রশ্নটি হুবহু মিলে গেছে। এর বাইরে ঢাকা থেকে ৩৪টি প্রশ্ন পাঠিয়েছেন এক শিক্ষার্থী, তাতে ৩৪টিই মূল প্রশ্নের সঙ্গে মেলে। অন্যটিতে ৬৪টির মধ্যে মিলেছে ৩২টি। এই প্রশ্নপত্রটি বিনিময় হয়েছে রবিন ও আশির মুরাদ তালুকদারের মধ্যে। প্রশ্ন বিনিময়ের পর আশির বলেন, ‘সব ডক্টর হইয়া যা।’
যশোর থেকে এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে পরীক্ষার দিন সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে দুই দফায় প্রশ্ন পেয়েছিল। এত করে বললাম প্রশ্নগুলো দেখে নে। ছেলে বলে কী, আসপেন না। ভুয়া প্রশ্ন।’ তাঁর ছেলেকে ছেলের বন্ধুরা হোয়াটসঅ্যাপে পরীক্ষার প্রশ্ন পাঠায় বলে তিনি জানান।
ফল প্রকাশের পর ফেসবুকে তিন শিক্ষার্থীর কথোপকথন বহুবার শেয়ার হয়। শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘অ্যাট লাস্ট গট চান্স অ্যাট ডিএমসি। ফাহিম, নাহিদ তোরা সকালে প্রশ্ন না দিলে মনে হয় না চান্স পেতাম। থ্যাঙ্কস ম্যান।’
ফাহিম শাহরিয়ার তাহসিন লেখেন, ‘যাক শেষমেশ মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেলাম। …থ্যাঙ্কস নাভিদ অ্যান্ড সাব্বির ফর দি কোয়েস।’ শ্রাবণ আহমেদ জয় (জয়ম) লিখেছেন, ‘ফাইনালি আই গট অ্যাডমিটেড ইন ডিএমসি…প্রশ্ন পাওয়াতে অনেক উপকার হলো আমার লাইফের, বাট প্রাইস কিন্তু ১৫ লাখ।’ তবে সন্ধ্যাবেলা তাঁরা এই বক্তব্যগুলো তুলে নেন। এঁদের মধ্যে ফাহিম শাহরিয়ার তাহসিন বলেন, তিনি নিছক মজা করার জন্য এসব লিখেছেন।
ব্রিফিংয়ে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ প্রতিমন্ত্রী: বেলা পৌনে একটার দিকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক অধিদপ্তরে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশ করেন। এ বছর এমবিবিএস ও বিডিএস পরীক্ষায় অংশ নেন ৮২ হাজার ৯৬৪ জন, পাস করেন ৪৮ হাজার ৪৪৮ জন। সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে আসনসংখ্যা ৩ হাজার ৬৯৪। এর বাইরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় আসন আছে ৭ হাজার ৩৫৫টি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েন। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আন্দোলন সম্পর্কে আমি পুরোপুরি জানার সুযোগ পাইনি। কৃতকার্য না হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে আন্দোলন করে থাকতে পারে। আমি তাদের বলব মাঠে আন্দোলন না করে বাড়িতে গিয়ে পড়ালেখা করতে।’ পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য তিনি শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান।
ওই ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মো. নুরুল হক বলেন, এসব অভিযোগ অবান্তর। পরীক্ষা সম্পর্কে যেকোনো তথ্য জানাতে নিয়ন্ত্রণকক্ষের নম্বর দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষার আগে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (শিক্ষা) এ বি এম আবদুল হান্নান বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা এবার ভালো করে লেখাপড়া করেছে। তাই ফল ভালো হয়েছে।’
পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চলবে: গতকাল সন্ধ্যায় অভিভাবকদের একজন আশরাফ কামাল বলেন, আজ পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁরা স্মারকলিপি দেবেন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাও করবেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ‘মেডিকেলে ভর্তি-ইচ্ছুক সকল শিক্ষার্থী’র ব্যানারে শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানান। মানববন্ধন শেষে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁরা অনশন ও মানববন্ধন করেছেন।
হাইকোর্টে রিট: ভর্তি পরীক্ষার ফল বাতিল এবং নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা প্রসঙ্গে ইউনূছ আলী বলেন, এমবিবিএস ও বিডিএস পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা ও রুল চাওয়া হয়েছে। এতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন ও স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালকসহ ১১ জনকে বিবাদী করা হয়েছে। এর আগে গত শনিবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য এবং প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে ইউনূছ আলী সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠান। ইউনূছ আলী বলেন, যে প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে, তার সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের মিল রয়েছে। ফাঁস হওয়া এ প্রশ্নপত্রের অনুলিপি তাঁর কাছে আছে। আজ সোমবার আবেদনটির ওপর শুনানি হতে পারে বলেও জানান তিনি।
সন্দেহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজনের প্রতি: রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএস এলাকা থেকে গত মঙ্গলবার বিকেলে র্যাব অভিযান চালিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে ১ কোটি ২১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা মূল্যমানের বিভিন্ন ব্যাংকের চেক, নগদ টাকা ও ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন-উত্তরপত্র এবং ভর্তি পরীক্ষার নিবন্ধনপত্র উদ্ধার করা হয়।
এ চক্রের প্রধান জসিম উদ্দিন ভূঁইয়াকে ২০১১ সালে একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অভিযোগ আছে, জসিম অধিদপ্তরের ছাপাখানার এক কর্মীর আপন খালাতো ভাই। ওই কর্মীকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে দুবার ছাপাখানা থেকে বদলি করে দেওয়া হয়। প্রভাব খাটিয়ে তিনি আবারও ফিরে আসেন ছাপাখানায়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (শিক্ষা) এ বি এম আবদুল হান্নান বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা তিনি জানেন না।