এই বিষয়ে লেখার ইচ্ছে হবার পিছনে একটি গল্প আছে। ডাঃ তাবাসসুম খান ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরের একজন প্রথিতযশা এক্সিকিউটিভ। মধ্যপ্রাচ্যের এবং মুসলিম দেশগুলোর ফার্মা মার্কেট নিয়ে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ বলা চলে। একসময় একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি জন্য তিনি আবার আমার সহকর্মীও ছিলেন বলা চলে। যখন আমরা দুজনেই সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়েছি তখন মালয়েশিয়ায় একটা বায়টেক প্রোজেক্টের সাম্ভব্ব্যতা যাচাইয়ের কাজ একসাথে করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তখন তাঁর প্রজ্ঞা আর বিভিন্ন সেক্টরে যোগাযোগের মাত্রা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।
কয়েকদিন আগে গ্লৌবাল ইসলামিক ইকনোমিক ফোরামে ডাঃ তাবাসসুমের একটা বক্তব্যের ভিডিও দেখলাম, যেখানে তিনি হালাল ভ্যাক্সিনের যৌক্তিকতা নিয়ে বলছেন। আমি আগ্রহ নিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনি। তাঁর বক্তব্যের মুল পয়েন্ট ছিল।
“হালাল বিষয়টা এসেছে শারিয়া থেকে, তাই ওষুধের কার্যকারিতা, সেফটি, কোয়ালিটির সাথে শারিয়া যুক্ত করে আমরা ইসলামিক দুনিয়াকে বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টের একটা কমপ্লিট প্যাকেজ দেবো। আমাদের ক্লাসিফাই করতে হবে কী কী অবশ্যই হালাল হতে হবে; কী কি জিনিস হালাল হতে পারে; এবং কী কী অবশ্যই হালাল হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিৎ নয়। আমাদের কখনোই হালাল “টাই” (নিজের পরিধেয় টাই দেখিয়ে বললেন) তৈরিতে যাওয়া উচিৎ নয়, তাহলে এটা কৌতুকপ্রদ হবে।”
আমি উনাকে বললাম যে “হালাল” বিষয়টা ইসলামের বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রস্তাবনার সাথে যুক্ত। এটা শারিয়া নয় কোরআন থেকে উৎসরিত। “হালাল” সংক্রান্ত ধারনাটি আরো পরিচ্ছন্ন ভাবে উপস্থাপিত করা গেলে আপনার কাজের সুবিধা হবে। পশ্চিমা বিশ্বের পাশে ইসলামের বিজ্ঞানের একটা নতুন প্যারাডাইম আপনি দাড় করাতে পারবেন।
আমি তাঁর জন্য ইংরেজিতে একটা লেখার ড্রাফট ও তৈরি করি। কিন্তু ভদ্রলোক আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। হয়তো ভেবেছেন এই শর্মা আবার ইসলাম নিয়ে কথা বলে কেন? তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিজ্ঞান সম্পর্কে ইসলামের প্রস্তাবনা সংক্রান্ত একটা লেখা বাংলায় লিখবো।
ইসলামের বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রস্তাবনার ভিত্তি হচ্ছে প্রকৃতি সম্পর্কে ইসলামের ধারণা, জ্ঞান ও মূল্যবোধের ঐক্য এবং ন্যায় ও কল্যাণ। ইসলামিক বিজ্ঞানের একটা কন্সেপচুয়াল ম্যাট্রিক্স আছে। এই ম্যাটিক্সের উৎস কোরআন। এই ম্যাট্রিক্স থেকেই ইসলামিক বিজ্ঞানের সংস্কৃতি উৎসরিত। এই ম্যাট্রিক্সে দশটা ধারণা বা কনসেপ্ট আছে। চারটি একক ধারণা; আর ছয়টি জোড়ায় যুক্ত ধারণা। জোড়ায় যুক্ত ধারণা গুলি তিনটি ইতিবাচক ধারণা আর তিনটি নেতিবাচক ধারণা। নিচের ডায়াগ্রামে বিষয় টি স্পষ্ট করা হয়েছে।
এই ম্যাট্রিক্সকে যখন মূল্যবোধে রুপান্তরিত করা হয় তখন এই ধারনাগুলি থেকে উদ্ভুত মূল্যবোধ বৈজ্ঞানিক অন্নেষাকে একটি সার্বিক ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসে। এই ম্যাট্রিক্সই তথ্য, উপাত্ত এবং মূল্যবোধকে একটি প্রাতিষ্ঠানিকতার অধীনে নিয়ে আসে যেই যেই প্রতিষ্ঠান সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।
কিন্তু ঠিক কীভাবে এই মূল্যবোধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একটি সমন্বিত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে?
“তৌহীদ” যার আক্ষরিক অর্থ ঐক্য এবং যেই ঐক্য আল্লাহর একত্বের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত। এই আল্লাহর ঐক্য সর্বব্যাপী মূল্যবোধ হয়ে ওঠে যখন এই ঐক্য জাহির করে বিশ্বমানবের ঐক্য, মানুষ এবং প্রকৃতির ঐক্য এবং জ্ঞান ও মূল্যবোধের ঐক্য। এই তৌহিদের ধারণা থেকেই আসে খলিফার ধারণা। সকল মরণশীল প্রাণী আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বরং আল্লাহর কাছে তাঁর সকল কাজ এমনকি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির চর্চার জন্য দায়বদ্ধ। খলিফা মানে ট্র্যাস্টিশিপ, এর অর্থ মানুষের এই পৃথিবীর প্রাণ ও প্রকৃতির উপর একছত্র অধিকার নাই, সে এগুলোর মালিক নয়, এগুলোকে সে ধ্বংস করতে পারেনা। সে শুধু তার সংরক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং এটাই তাঁর পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক যাত্রায় দায়িত্ব। এবং যেহেতু জ্ঞান প্রকৃতির ধ্বংস করে আহরন করা যায়না আবার বিজ্ঞানীকে নিছক একজন পর্যবেক্ষক হিসেবেই ইসলাম কল্পনা করেনা তাই জ্ঞানের পথ হচ্ছে ইবাদতের পথ, যেই পথে আত্ম, তৌহীদ আর খলিফা সম্পর্কে উপলব্ধি করবে। তৌহীদ আর খলিফা সম্পর্কে উপলব্ধিই হচ্ছে ইবাদত। একটি নির্দিষ্ট অবশ্য পালনীয় ইবাদত পদ্ধতি হচ্ছা “সালাত”। সালাতের মানে হচ্ছে সংযোগ। স্রস্টার সাথে সৃষ্টির সংযোগ যখন সৃষ্টি স্রষ্টার মাধ্যমে সকল সৃষ্টির সাথে সংযোগ স্থাপন করে সেটাই সালাত। আল্লাহর একত্বের উপলব্ধির অনেক দৃষ্টিভঙ্গির একটি হচ্ছে জ্ঞানের সাধনা। যদি বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড ইবাদত হয় তাহলে এটা নিঃসঙ্কোচে বলা যায় এই বিজ্ঞান যা আসলে ইবাদত তা প্রকৃতি এবং প্রাণের বিনাশ করবেনা। এমনকি কোন অপচয় বা “রিয়া” করবেনা কোন জুলুমের উপায় হবেনা এমনকি এমন কোন ফলের লক্ষ্যে ধাবিত হবেনা যা “হারাম”।
কন্সেপচুয়াল ম্যাট্রিক্সে “হালাল” শুধু খাদ্য বা সৎ উপার্জনের অর্থেই ব্যবহার করা হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে যে কোন ধরনের প্রশংসনীয় লক্ষ্য (প্রেইজ অর্দি গৌল) কেও। তাই ইসলামিক বিজ্ঞানে পারমানবিক বোমা হারাম। কুমিরের চামড়ার টাই তৈরিও হারাম। ইসলামিক বিজ্ঞান প্রাণ ও প্রকৃতি বিধ্বংসী নয়। এটা অতিশয় কৌতূহল উদ্দীপক যে কেমিস্ট্রিতে মুসলিম বিজ্ঞানিরা পৃথিবী সেরা হলেও তাঁরা “বারুদ” আবিস্কার করেনি।
পশ্চিমা বিজ্ঞানের অবস্থান ইসলামিক বিজ্ঞানের বিপরীতে। তাঁরা প্রকৃতিকে বশীভূত করতে চায়। প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করে নিজের মুক্তি চায়। সেকারনেই পশ্চিমা বিজ্ঞান প্রকৃতি বিধ্বংসী। ইসলামকে পশ্চিমের চিন্তার সার্টিফিকেইট নেয়ার প্রয়োজন নেই। ইসলামের নিজস্ব বিজ্ঞান চিন্তা আছে আর সেটা পশ্চিমের চাইতে অনেক বেশী গণমুখী, অনেক কল্যাণময়, অনেক ন্যায়ের।
দোহাই ও টোকাটুকিঃ
১/ Encyclopaedia of the History of Science, Technology, and Medicine in Non Western Culture. edited by Helaine Selin
২/ Within the Four Seas--: Introduction to Comparative Philosophy; By Ulrich Libbrecht
৩/ Sardar, Ziyauddin. 1984. The Touch of Midas : science, values and environment in Islam and the West. Manchester: Manchester University Press.
৪/ Introducing Philosophy of Science: A Graphic Guide by Zianuddin Sardar
সূত্র: চিকিৎসক, গবেষক ও লেখক ডা: পিনাকী ভট্টাচার্য-এর ফেসবুকে প্রকাশিত নোট