নয়-ছয় সুদনীতি ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাজারের যা খবর, তাতে মোটামুটি সব ব্যাংকই তা কার্যকর করছে। এর অর্থ হচ্ছে সস্তায় আমানত (ডিপোজিট) এবং সস্তায় ঋণ। এখন প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে সঞ্চয়কারীদের নিয়ে। তাদের কী হবে? এরই মধ্যে এ নিয়ে কাগজগুলো নানা খবর প্রকাশ করেছে। স্টোরির সংখ্যা বেড়েছে, বিশেষ করে ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পে সুদহার মোটামুটি অর্ধেকে হ্রাস করার পর। দু-চারদিন আগেই এটি করা হয়েছে। ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পের গ্রাহক ও সেবা সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত।
ধরা হয় ডাকঘরের কোটিখানেক গ্রাহক আছে। তারা ছোট গ্রাহক। তাদের আয় অর্ধেকে হ্রাস পাওয়ায় নানা আশঙ্কার জন্ম হচ্ছে। অন্তত দুজন বড় অর্থনীতিবিদ বলেছেন, এর প্রভাব পড়বে সঞ্চয়ে। মানুষ জমি, ফ্ল্যাট, সোনাদানার দিকে ঝুঁকতে পারে। এমনকি সর্বনাশী মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির পাল্লায় পড়তে পারে সাধারণ মানুষ। নানা ধরনের সমবায়ও তো কম যায় না। এদের খপ্পরেও পড়তে পারে।
কেন? উত্তর খুব সহজ। ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পের গ্রাহকরা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। গ্রামের বিধবা নারী, রেমিট্যান্স প্রাপক, বৃদ্ধ মানুষ, স্বামী পরিত্যক্তা, অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি লোকজনই হচ্ছে ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পের গ্রাহক। গ্রাহকদের এ অবস্থা বিবেচনা করে ১০-২০ টাকায়ও হিসাব খোলার সুযোগ রাখা আছে সেখানে। শুধু ছোট ছোট সঞ্চয়কারীর সঞ্চয় হেফাজতে রাখার উদ্দেশ্যে নয়, আরো একটি উদ্দেশ্যে ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পগুলো করা হয় এবং এতে উৎসাহ দেয়া হয়। গ্রামাঞ্চলে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান, সমবায়, সংঘ ইত্যাদি করে অসাধু লোকজন গরিবের কাছ থেকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। এসব দুর্বৃত্তের হাত থেকে সাধারণ সঞ্চয়কারীদের রক্ষা করাও ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।
বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লাখ লাখ সঞ্চয়কারী ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পের অধীনে আসা সত্ত্বেও আমরা দেখেছি এবং এখনো দেখছি বিচিত্র সব সংগঠন গ্রামাঞ্চলে মানুষের টাকা লুট করার কাজে নিয়োজিত। এ লুটের কাজে ‘সুনাম’ দুর্নাম অর্জন করে ডেসটিনি নামের একটি কোম্পানি। মাল্টি লেভেল মার্কেটের নাম করে গ্রাম ও শহর থেকে প্রতিষ্ঠানটি হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নেয়। এক্ষেত্রে আরো দুষ্টচক্র ছিল ‘ইউনিপেটুইউ’। এ দুই প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়।
অনুমান করা হয়, এখনো বাজারে দুই ডজনের মতো কোম্পানি এই ছলচাতুরির ব্যবসায় নিয়োজিত। কেউ ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসার নামে, কেউ মার্কেটিংয়ের নামে, কেউ সমবায়ের নামে, কেউ সঞ্চয়ী প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়মিতভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা গায়েব করে দিচ্ছে।
খবরের কাগজে বিশেষ করে বণিক বার্তার প্রতিবেদনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম দেখেছি। যেমন লাইফওয়ে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড, প্রাইম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, দ্য ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড, চলন্তিকা যুব সোসাইটি, রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, আজিজ কো-অপারেটিভ ইত্যাদি।
এসব প্রতিষ্ঠান আইনের ফাঁকফোকরে প্রতি বছর লাখ লাখ সঞ্চয়কারী, ছোট ছোট সঞ্চয়কারীর টাকা লুট করছে। একসময় শুনেছিলাম যশোরের কাজল ব্রাদার্সের কথা, যারা চোরাচালান ফিন্যান্স করত। এসব ‘সানড্রি’ প্রতিষ্ঠান শুধু নয়, সংগঠিত ব্যবসাও (অর্গানাইজড সেক্টর) একই কাজে ব্যাপৃত বলে বহুদিন ধরে অভিযোগ। গ্রামাঞ্চলে বীমা কোম্পানিগুলো জীবন বীমা করছে। নানা লোভ দেখিয়ে তারা ‘প্রিমিয়াম’ সংগ্রহ করছে। অশিক্ষিত মানুষ জানে না নিয়মিত প্রিমিয়াম না দিলে তারা তাদের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। কিছুদিন আগের কথা। বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি মেয়ের কথা। সে কাজ করে ঢাকার একটি বাসায়। সে গরিব জেলে পরিবারের। বাবার বীমা করা হয়। প্রিমিয়াম দিচ্ছে মেয়েটি। বাবা মারা গেলে বীমার টাকা দাবি করা হয়।
প্রথমে চাওয়া হয় ডাক্তারের সার্টিফিকেট যে তিনি মারা গেছেন। দ্বিতীয়ত চাওয়া হয় ‘শ্মশান ঘাটের’ সার্টিফিকেট। তারপর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট। গ্রামের লোক, কোথায় তারা পাবে ডাক্তারের সার্টিফিকেট, কোথায় শ্মশানঘাটের সার্টিফিকেট? বিচিত্র সব দাবির মুখে ওই ভদ্রলোকের পরিবার বীমার টাকা আজও পায়নি, কালও পায়নি। অন্যদিকে বহু কোম্পানির মধ্যে অনেকগুলোর তো ঠিকানাই খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একশ্রেণীর লুটেরা, যাদের হাত বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা ঘটছে কখন? ঘটছে দেশে ১০-১১ হাজার ব্যাংক শাখা কাজ করা সত্ত্বেও; সারা দেশে হাজার হাজার পোস্ট অফিস, সাব-পোস্ট অফিস কাজ করা সত্ত্বেও। ভালো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এরা মোটামুটি ভালো সুদ দেয়। এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাংকে আমানত রাখলে সুদ দেয়া হবে ৬ শতাংশ। এর থেকে আয়কর কাটা হবে ১০-১৫ শতাংশ।
অথচ মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ। সবচেয়ে বড় কথা, সব আমানত তো মেয়াদি আমানত নয় যে, ৬ শতাংশ হারে সুদ দেবে ব্যাংক। সঞ্চয়ী হিসাবে ব্যাংকে অনেক আমানত আছে এখন। এর ওপর ২-৩ শতাংশ সুদও ব্যাংক দেয় না। ব্যাংকে না হোক, সরকারের জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের অনেক সঞ্চয়পত্র আছে, তাতে মানুষ টাকা বিনিয়োগ করত। সঞ্চয়কারীরা এতে ভালো সুদ পেত। কিন্তু করা হয়েছে কড়াকড়ি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লাগবে, ‘টিআইএন’ লাগবে, লাগছে ‘এনআইডি’। দেখাতে হবে অর্থের উৎস। তারপর সুদের হার কমানো হয়েছে। আয়করের হার বাড়ানো হয়েছে। ক্রয়ের ঊর্ধ্বসীমা হ্রাস করা হয়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি সীমিত হয়ে পড়েছে। এর পরও মানুষ যেতে পারত ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পে। সর্বশেষ সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই স্থলে সুদের হার কমিয়ে অর্ধেকে নামানো হয়েছে। প্রশ্ন তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? যাবে শেয়ারবাজারে? বড় বিপদের কথা। গত ১০ বছর দু-দুবার এ বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে একশ্রেণীর শেয়ার ব্যবসায়ী ও তাদের দোসররা। কোম্পানির মালিকরা উচ্চদরে তাদের শেয়ার বিক্রি করে শেয়ারহীন দিগম্বর পরিচালক হয়েছেন। তাদের ন্যূনতম শেয়ার থাকার কথা। অভিযোগ, তাই তারা শেয়ারবাজারের পতন ঘটাচ্ছেন। এখন তারা কিনছেন। এবার আবার বিক্রি করবেন উচ্চদরে।
তাই পুঁজিবাজারের জন্য এক একটি ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকার তহবিল সৃষ্টি করাচ্ছেন। ৫৯টি ব্যাংকের তাহলে বাজারে আসবে ১০-১২ হাজার কোটি টাকা। চাহিদা বাড়বে। এখন কেনা শেয়ার তখন বিক্রি করে আবার লুট করবেন। এ অভিযোগ সত্যি হলে খুবই দুশ্চিন্তার কথা। এ অবস্থায় এই বাজারে কে যাবে শেয়ার কিনতে? অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন সঞ্চয়কারীরা আবার মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর ষড়যন্ত্রের শিকার হবেন। তারা লাভ-লোভ দেখাবে। মানুষেরও কোনো বিকল্প নেই। অতএব, উচ্চদর অনিশ্চতায় মানুষ এসব শ্যাডো ব্যাংকিংয়ের আশ্রয় নেবে। কেউ কেউ যাবে অনুৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে। জমি কিনবে, ফ্ল্যাট কিনবে, সোনাদানা কিনবে, ডলার-পাউন্ড কিনবে। আর একটু বড় যারা, তারা টাকা বিদেশে পাঠাবে। কেন এমন হবে? হবে, কারণ সঞ্চয়কারীদের বিনিয়োগ করার জায়গা দরকার। আমাদের দেশে মায়েরা, খালা-মাসিরা শাড়ির আঁচলে সঞ্চিত টাকা রাখেন।
সঞ্চয় করেন তারা দুর্দিনের জন্য। দুর্দিনে সরকার তাদের কোনো সাহায্য করে না। ভাত না পেলে ভাত দেয় না। চিকিৎসা ও ওষুধ না পেলে সরকার চিকিৎসা-ওষুধ দেয় না। লেখাপড়ার খরচ সরকার দেয় না। এ অবস্থায় আমাদের সঞ্চয়ের প্রবণতা সুপ্রাচীনকালের। এ সঞ্চয় তারা রাখতেন ব্যাংকে, ডাকঘরে, সঞ্চয়পত্রে এমনকি শেয়ারবাজারে। এখন দিন দিন সব পথ বন্ধ হয়েছে/হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে বিকল্প খুঁজছে মানুষ। সবাই তো আর ব্যবসা করতে পারবে না। অনেকেরই সেই বুদ্ধি নেই, বয়স নেই, ধৈর্য নেই, পারিবারিক ঐতিহ্য নেই। অতএব, এই অসহায় নিম্নবিত্ত, গরিব, সাধারণ মধ্যবিত্ত কোথায় যাবে? সর্বত্র এ প্রশ্ন। তাদের কথা কি কেউ শুনছে? শুনবে? কেউ কি বিকল্প বিনিয়োগের ব্যবস্থা করবে, যাতে মানুষ অন্তত দুবেলা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভালো বেতন পাচ্ছেন এবং পরে পেনশন পাবেন। তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদ কিন্তু কমেনি। মুশকিল হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আর কয়জন দেশে? তারা বাদে, ব্যবসায়ীরা বাদে দেশে তো অনেক লোক। এদের কে বাঁচাবে।
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক