স্যাটেলাইটের কল্যাণে সুদূর আমেরিকা-ইউরোপের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবনযাপন আমাদের অজানা নেই। অথচ ঘর থেকে শুধু দুই পা দূরের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর জীবনযাপন সম্পর্কে জানিনা। অনেক ভাষা আমাদের প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে বগলদাবা করা আছে। কখনও জানার প্রয়োজনে, কখনওবা সিনেমার প্রতি আগ্রহেই শিখেছি বিভিন্ন দেশের ভাষা। তেমনই দুটি শব্দ 'মর থেংগারি'। শব্দ দুটি বাংলা নয়। চাকমা ভাষা। অর্থ 'আমার সাইকেল।' 'মর থেংগারি' আমাদের দেশেরই চলচ্চিত্র। অথচ শুধুমাত্র ভাষাগত অসঙ্গতির কারণ দেখিয়ে সেন্সরশিপ দেওয়া হয়নি।
ভাষাটা হয়তো দুর্বোধ্য কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে দেশ বিদেশের বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করে ফেলছি। প্রয়োজনে ইন্টারপ্রেটার অথবা সাবটাইটেল ব্যবহারের মাধ্যমে ভিনদেশী ভাষাকেও বোধগম্য করে তুলছি। সেখানে কিনা ভাষাগত কারণ দেখিয়ে মুভিটিকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিনেমার গল্পের শুরুটা একজন যুবকের কিছু কষ্ট, দুঃখঘেরা স্মৃতির কথোপকথনের মাধ্যমে। এতে আছে কর্ণফুলী নদীর গ্রাসে হারিয়ে যাওয়া নিজেদের ঐতিহ্য, সাম্রাজ্য, বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার গল্প।
একজন বেকার যুবকের জীবনের গল্প একটি সাইকেলকে ঘিরে। একটা প্রায় জনমানবনহীন গ্রামে তার জন্ম, যেখানে সাইকেলের মত একটা যানবাহন মানেই ছিল অনেক কিছু। শহর থেকে কর্মহীন হয়ে ফিরে আসা যুবক নিজের গ্রামে এসে নিজের একমাত্র সম্বল সাইকেল নিয়ে ছোট্ট সংসারটাকে সুন্দর ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিছু ক্ষমতাবান লোকের লোলুপ দৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার সাইকেলটি। এক পর্যায়ে দেখা যায়, তারা সাইকেলটাকে ভেঙে লুকিয়ে রেখে দেয় ঝোপের মধ্যে। একটা ভাঙা সাইকেলের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় যুবকটির স্বপ্নও। গল্পের যবনিকায়ও দেখা যায় সেই একই কর্ণফুলী নদীর কাছেই ফিরে যাওয়া সেই ভাঙা সাইকেল নিয়ে। অতঃপর উদ্দেশ্য আবার শহরে পাড়ি জমানো।
চাকমা ভাষায় নির্মিত এটিই প্রথম চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্রটির নির্মাতা অং রাখাইন। আমরা সারাদিন গোগ্রাসে গিলতে থাকি হিন্দি সিনেমা, এমন কি তামিলনাড়ু থেকে শুরু করে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ কিংবা জাপানি মুভি পর্যন্ত। প্রতিবেশী দেশের হিন্দি ভাষায় করা মুভি পর্যন্ত আমাদের দেশে যেখানে ছাড়পত্র পায় সেখানে শুধুমাত্র চাকমা ভাষায় নির্মিত হওয়ার কারণে এই মুভিটিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় নি। কথিত আছে নীতিমালায় নাকি ইংলিশ আর বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষার মুভি ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। যদি শুধুমাত্র এই কারণেই মুভিটির প্রচারে বাধা থাকে তাহলে সেটা হবে নীতিমালার প্রচণ্ড একটা দুর্বলতা। চাইলেই নীতিমালায় পরিবর্তন এনে মুভিটিকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়।
যেখানে হিন্দি সিনেমা আমদানিতে কোন বাধা নেই, সেখানে শুধুমাত্র চাকমা ভাষা হওয়ার কারণে একটা নতুন সৃষ্টিকে, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটা প্রয়াসকে আটকিয়ে দেওয়া আসলে নিজেদের দেশেরই একটা সংস্কৃতিকে গলা টিপে মেরে ফেলারই মত। তবে মূল ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায় মাছকে অনেকটা শাক দিয়ে ঢেকে দেওয়ার মত। ভাষাগত কারণটা ছিল একটা অজুহাত। মুভিটিতে দেখানো হয়েছিল সেনা কর্তৃত্ব। যেটাকে বিশ্বের কাছে জানতে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। মাটির ময়নার মত মুভিকে যেখানে ধর্মান্ধতার কারণে ছাড়পত্র পেতে পোড়াতে হয়েছিল অনেক কাঠখড় সেখানে আদিবাসীদের এই মুভিটাকেও রাষ্ট্রের অপকর্মকে ঢেকে রাখার জন্য করে রাখা হয়েছে অবদমিত। তার মানে ধারণা করা যায় কখনও যদি সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়েও কোন চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় সেটাকে সম্মুখীন হতে হবে অনেকগুলো রাষ্ট্রীয় পরীক্ষার।
ধর্মীয় গোঁড়ামি, কিছু সম্প্রদায়ের অবহেলিত জীবনযাপনের গল্পগুলোকে যখন কোন ব্যক্তি তাঁর নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ করতে চান তাঁকে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিকল। বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিছু ভিত্তিহীন যুক্তি। অপ্রকাশিত সত্যগুলোকে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বেড়ি। আমরাই আবার দিন শেষে গলা চিল্লিয়ে বলতে ভালবাসি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। যেখানে চাপা পড়ে যাচ্ছে আসলে গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, অজ্ঞানতা আর কিছু সম্প্রদায়ের অবহেলিত জীবনযাপনের সাতকাহন।
সৌজন্যে- বাংলামেইল২৪ডটকম