আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা-সরবরাহে ভারসাম্য ফিরিয়ে দরপতনের লাগাম টানতে রীতিমতো গলদ্ঘর্ম হচ্ছে সৌদি আরব, রাশিয়াসহ ওপেক-নন ওপেক জোটের সদস্যরা। সম্মিলিতভাবে উত্তোলন কমানোর মধ্য দিয়ে জ্বালানি পণ্যটির মূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে জোট সদস্যরা।
তবে এ জোটে নেই যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দরপতন রোধে কোনো উদ্যোগও নেয়নি দেশটি। উল্টো মার্কিন উত্তোলন খাত দিন দিন চরম চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এ ধারাবাহিকতায় গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের কূপগুলো থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন ১১ শতাংশ বেড়েছে। এমনকি দেশটিতে জ্বালানি পণ্যটির দৈনিক গড় উত্তোলন রেকর্ড ১ কোটি ২০ লাখ ব্যারেলের মাইলফলক ছাড়িয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ভারসাম্য ফেরানোর পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে চিহ্নিত করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খাত নতুন রেকর্ড গড়েছে। দেশটির এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কূপগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালে দেশটিতে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন হয়েছিল। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে দেশটিতে জ্বালানি পণ্যটির দৈনিক গড় উত্তোলন বেড়েছে ১২ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
যদিও ২০১৯ সালে দেশটিতে জ্বালানি তেল উত্তোলনে প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের তুলনায় কমে এসেছে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছিল। ইআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের নভেম্বরে মার্কিন জ্বালানি তেল উত্তোলন খাত ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড অবস্থানে পৌঁছেছিল। ওই মাসে দেশটির কূপগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন হয়েছিল। দেশটির ইতিহাসে এটাই জ্বালানি পণ্যটির সর্বোচ্চ মাসভিত্তিক উত্তোলনের রেকর্ড।
বিদায়ী বছরে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস উপকূলের কূপগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন হয়েছে। ইআইএর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলের কূপগুলো থেকে গত বছর প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ ৭০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে উত্তোলন হওয়া মোট জ্বালানি তেলের ৪১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে টেক্সাসে জ্বালানি পণ্যটির দৈনিক গড় উত্তোলন রেকর্ড ৫৩ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেলে উঠেছিল।
একইভাবে টানা তিন বছরের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় নিউ মেক্সিকো উপকূলে গত বছরও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট উত্তোলন হওয়া জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ জোগান দিয়েছে এ অঞ্চল।
শুধু গত বছরের চাঙ্গা ভাব নয়, চলতি বছরও মার্কিন উত্তোলন খাত আরো চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছে ইআইএ। প্রতিষ্ঠানটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের কূপগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৩২ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলনের সম্ভাবনা রয়েছে। আর ২০২১ সাল নাগাদ দেশটিতে জ্বালানি পণ্যটির দৈনিক গড় উত্তোলন আরো বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১ কোটি ৩৬ লাখ ব্যারেলে। নিউ মেক্সিকো ও টেক্সাসের পারমিয়ান অঞ্চলের কূপগুলো থেকে বাড়তি উত্তোলনের জের ধরে আগামী বছরগুলোয় মার্কিন জ্বালানি তেল উত্তোলন খাত আরো চাঙ্গা হতে পারে বলে জানিয়েছে ইআইএ।
এদিকে চলতি মাসেই অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বৈঠকে বসছে ওপেক-নন ওপেক জোট। এ বৈঠকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন বর্তমানের তুলনায় আরো কমিয়ে আনতে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে সৌদি আরব, রাশিয়াসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। এছাড়া ওপেকের সামনে বিকল্প পথ নেই। কারণ বছরের শুরু থেকে চীনে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। এতে বেচাকেনা কমে জ্বালানি পণ্যটির বাজারে নতুন করে দরপতন দেখা দিয়েছে।
চলতি মাস নাগাদ নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে পুরো বিশ্বে। এ সংকট সামগ্রিক বৈশ্বিক অর্থনীতিকে শ্লথ করে দেয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। রয়টার্সের পণ্যবাজারবিষয়ক বিশ্লেষক ওয়াং তাও বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথতা দেশে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা আরো কমাবে। জোরদার হতে পারে দরপতন। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে জ্বালানি পণ্যটির রফতানিকারক দেশগুলো। এ অবস্থা আগাম সামাল দিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন বর্তমানের তুলনায় আরো কমিয়ে বাজারে লাগাম টানতে চাইছে ওপেক-নন ওপেক দেশগুলো। তবে এ উদ্যোগে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক মার্কিন উত্তোলন খাতের রেকর্ড চাঙ্গা ভাব।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস