ঢেলে সাজানো গত বছর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে ডিএসইর সব সূচক ক্রমাগত পড়েছে। ভয়ংকর। ‘শেয়ারবাজারে ধস’ নামের রিপোর্ট অনেক খবরের কাগজে। আর যদি কোনো ব্রোকারেজ হাউসের অফিসে যান, দেখবেন বিনিয়োগকারীদের আসন সব খালি। করোনাভাইরাস না আসতেই সবাই যেন গৃহবন্দী। করোনাভাইরাস না আসুক, আমাদের দরকার করুণা নামের ভাইরাস। সদাসয় সরকার তাই সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক আর আইসিবিকে তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে বলল বলেই শুনলাম। এ বছরই গত ফেব্রুয়ারি মাসে সূচক বাড়তে লাগল ১১ তারিখ থেকে, ক্রমাগত। প্রতিদিন বাড়তে বাড়তে ৪ হাজার ৫০০-এর কোঠা ছাড়িয়ে ৫ হাজার ছঁইছুঁই, কিন্তু হলো না। ১৭ তারিখের পরে মাত্র এক সপ্তাহ ওঠার পর সূচক পড়তে লাগল। যেই কে সেই।
বাংলাদেশের বাজারের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, গল্পটা তাঁদের কাছে নতুন নয়। এ রকম চেষ্টা আরও অনেক হয়েছে, কিন্তু শেয়ারবাজারে লাগাম পরানো যায়নি। আসলে ব্যাকরণ বলে সেটা সম্ভব নয়। আপনি বলতে পারেন যেসব দেশে জাতীয় উন্নয়নের সূচক জিডিপি অনেক কম, তাদের মতো মার্কেট ক্যাপিটাল হয় না কেন। সূচক তাদের মতো ‘চাঙা’ থাকে না কেন?
আমি ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে এ বিষয়ে একটু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। মতামত থাকবে আইনস্টাইন কিংবা নিউটনের; কিন্তু আমার মতো অভাজনও যদি শেয়ারবাজারের চমকপ্রদ তথ্যে চমকে উঠে, তবে আলোচনা করাই যায়। আমি একটা সংক্ষিপ্ত আর সরাসরি ওষুধ বাতলাতে চাই। সেটা হচ্ছে পুঁজিবাজারকে ঢেলে সাজানো নয়, বরং পুঁজিবাদের তন্ত্রমন্ত্র স্পষ্ট করতে আর অর্থের সজীব গতিশীলতা নিশ্চিত করতে বেশ কতগুলো চাকা যোগ করতে হবে। দুই চাকার সাইকেল যেমন পাঁচ টনি ভার নিতে পারে না। আমাদের পাঁচ টনি ট্রাক লাগবে। আর সেটা হতে হবে সমগ্র বাংলাদেশের জন্য।
পুঁজিবাজারে একটা কথা আছে—ইংরেজিতেই ভালো শোনায়—‘মেইক দ্য ট্রেন্ড ইওর ফেন্ড’। সূচকের ধারা তা বাড়তিই হোক বা কমতিই হোক, একজন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন আর অতিলোভী নন, এমন একজন শেয়ারের দাম বাড়া-নামা নিয়ে অস্থির হবেন না। সে জন্য পুঁজিবাদী বা উন্মুক্ত অর্থনীতিতে প্রচলিত এবং অতি ব্যবহার্য একটা জিনিস আছে। যেসব দেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে আমরা প্রায়ই আমাদেরটা তুলনা করি, সেসব দেশেই এই চাক্কাটা আছে।
আমি শর্ট সেলের কথা বলছি—যে জিনিস আমার নেই, সেই জিনিস বিক্রি করা অপরাধ বা নীতিগতভাবে ঠিক নয়—এমন ধারণা আমাদের মনে দৃঢ়ভাবে প্রথিত; কিন্তু উন্মুক্ত অর্থনীতিতে, বিশেষ করে পুঁজিবাজারে ব্যাপারটা সামান্য অন্য রকম। আমি এখন যদি হাইকোর্ট বিল্ডিং বিক্রয় করতে চাই, নিঃসন্দেহে জেলখানায় যেতে হবে; কিন্তু আমি যদি আমার আমবাগানের আগামী বছরের ফল এখন বিক্রি করি, কারও আপত্তি থাকে না। এই ব্যবসায়ী রীতি হাজার বছর ধরেই প্রচলিত। উদাহরণ হিসেবে একটি হাদিসের কথা উল্লেখ করা যায়। গাছে ফল পাকতে না পাকতেই খেজুরবাগান (বাগানের ফল-গাছ নয়) বিক্রি করা যায়। দাম ঠিক হবে গত দিনগুলোর ট্রেন্ড দেখে। তবে শর্ত আছে।
শর্ত বলার আগে বলে নিই যে শেয়ারবাজারে প্রতিটি বেচাকেনায় দুই ধরনের মানসিকতা বা চিন্তা কাজ করে। যিনি ভাবছেন শেয়ারের দাম পড়ে যাবে, তিনি বেচতে অর্ডার দেবেন তাড়াতাড়ি। যদি কেউ মনে না করেন যে দাম বাড়বে, তিনি তাড়াতাড়ি কিনতে অর্ডার দেবেন। একই সঙ্গে এই দুই মতের মানুষ না থাকলে একটা শেয়ারও বেচাকেনা হয় না। তাই যদি আমি বাড়তি বাজারে মনে করি যে আগামীকাল দাম আরও পড়বে তাহলে আজ কেন, কালকেই কিনব। বিক্রেতা এখানে ক্রেতা পাবেন না। স্টক এক্সচেঞ্জে বেচাকেনার পরিমাণ যাবে কমে। এবার যদি আমি মনে করি দাম কমবেই এবং আজ যদি বেচা যেত (আমার কাছে শেয়ার নেই), কাল আরও কম দামে কিনে সেটেলমেন্ট করে দিতাম। দুটো পয়সা তাহলে আসে। এটাকেই বলছি শর্ট সেল। যেকোনো সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে ইন্টারনেটে দেখুন। দুনিয়ার কোনো একচেঞ্জে এই শর্ট সেল অনুমোদিত নয়, খুঁজে পাবেন না (পেলে জানালে বাধিত হব)।
শর্তের কথা বলি। শেয়ারের দাম যদি কাল বেড়ে যায়, তবে আপনি শর্ট সেল করলে লোকসান গুনবেন, কিন্তু শেয়ার তো দিতেই হবে। তাহলে? শেয়ার ধার নেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শেয়ারের দাম যা-ই ওঠা-নামা করুক না কেন, সেটেলমেন্টে ফেল করা যাবে না, কিন্তু সামান্য পয়সার বিনিময়ে ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়াম মনে করে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সিডিবিএল থেকে, কারও অ্যাকাউন্ট থেকে ধার করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে। বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই রোজ রোজ শেয়ার বেচা-বিক্রি করেন না। তাঁরা আপনাকে ধার দিয়ে দুপয়সা কামাবেন। আপনি নিজেও ধার দিতে পারেন, যদি এভাবে শর্ট সেল অনুমোদন পায়। সেটেলমেন্টে কখনোই ফেল করা যাবে না। তার দরকারও হবে না। আমাদের বাজারে শর্ট সেল অবিলম্বে অনুমোদন দেওয়া হবে, এটি আশা করি। তাতে সবচেয়ে লাভবান হবে করিতকর্মা শেয়ার ব্যবসায়ীরা। আর বেচা-বিক্রির ভারসাম্য এলে বাজার একটা নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে ওঠা-নামা করবে। সবার ভালো হবে।
ওয়ালি উল মারুফ মতিন : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মসলিন ক্যাপিটাল
সূত্র: প্রথম আলো।
সানবিডি/এসকেএস