আবুজর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) তাঁর মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেন। আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দারা! আমি আমার জন্য জুলুম হারাম করেছি আর তা (জুলুম) তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম কোরো না। ...’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৭৩৭)
আলোচ্য হাদিসে মহান আল্লাহ মানুষকে পরস্পরের প্রতি জুলুম করতে নিষেধ করেছেন এবং জুলুমের ঘৃণ্যতা বোঝাতে তিনি নিজের জন্য জুলুম হারাম করার ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ আল্লাহ তাআলা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি জুলুম করতে চাইলে তা প্রতিরোধ করার মতো ক্ষমতা কারো নেই। মুমিনের জন্য এ কথার ওপর ঈমান আনা আবশ্যক যে আল্লাহ কারো প্রতি জুলুম করেন না।
জুলুমের ভয়াবহতা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই জুলুম কিয়ামতের দিন ভীষণ অন্ধকারে পরিণত হবে।’ (আল জামি বাইনাস সাহিহাইন, হাদিস : ১৩৮৭)
আল্লাহ কেন জুলুম করেন না
পূর্ণ ক্ষমতা থাকার পরও আল্লাহ কোনো সৃষ্টির প্রতি অবিচার করেন না। না মানুষের প্রতি, না অন্য কোনো সৃষ্টির প্রতি। কেননা জুলুম ন্যায়পরায়ণতার বিপরীত—যা মহান আল্লাহর শানবিরোধী। আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার দাবি হলো তিনি ‘জুলুম’ বা অবিচার থেকে অমুখাপেক্ষী। তাঁর কোনো ইচ্ছা পূরণের জন্য অবিচার করার প্রয়োজন হয় না। কেননা আল্লাহর ইচ্ছা অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ্য। সুতরাং আল্লাহ কারো প্রতি জুলুম করেন না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি বান্দাদের ওপর কোনো জুলুম করি না।’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ২৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতি কোনো জুলুম করতে চান না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৮)
শায়খ ইবনে উসায়মিন (রহ.) বলেন, ‘যদি জুলুম করা আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব হতো তা হলে ‘জুলুম থেকে বিরত থাকা’ কোনো প্রশংসনীয় কাজ হতো না। পৃথিবীর রীতি হলো কর্তার জন্য তখনই প্রশংসা করা হবে, যখন তার কোনো কাজ করা বা না করার সক্ষমতা থাকে।’ (তালখিসুল মুঈন : ১/১২০)
আল্লাহর ‘না বাচক’ গুণের ব্যাখ্যা
কোরআন ও হাদিসে আল্লাহর যেসব ‘না বাচক’ গুণাবলির উল্লেখ আছে তার উদ্দেশ্য বিপরীত গুণ সুদৃঢ় করা। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আপনার প্রভু কারো ওপর জুলুম করেন না।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৪৯)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কোনো কিছু তাঁর অগোচরে নেই।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ৩)
অনুরূপ ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁকে না তন্দ্রাচ্ছন্নতা আর না ঘুম স্পর্শ করে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৫)
উল্লিখিত তিনটি আয়াতে আল্লাহর তিনটি ‘না বাচক’ গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা মূলত আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা, জ্ঞানের পরিপূর্ণতা ও তাঁর চিরস্থায়ী ও চিরজীবী হওয়ার গুণগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে।
পরস্পরের প্রতি জুলুম নিষিদ্ধ
আল্লাহ শুধু নিজের ওপর জুলুম হারাম করেননি; বরং বান্দার জন্যও পরস্পরের প্রতি জুলুম নিষিদ্ধ করেছেন। যেমনটি আলোচ্য হাদিসে বিবৃত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ওই সব জনপদ—তাদের অধিবাসীদের আমি ধ্বংস করেছিলাম, যখন তারা জুলুম করেছিল এবং তাদের ধ্বংসের জন্য আমি স্থির করেছিলাম একটি নির্দিষ্ট ক্ষণ।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৫৯)
পাপকাজ নিজের প্রতি জুলুম
আল্লাহ মানুষের জন্য যা আবশ্যক করেছেন তা পরিহার করা এবং যা নিষিদ্ধ করেছেন তাতে লিপ্ত হওয়াও জুলুম বা অবিচার। আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে বান্দা নিজের ওপর অবিচার করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপ ও অবিচার হলো এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম।’ (সুরা : লোকমান, আয়াত : ১৩)
জুলুমের প্রথম প্রতিকার অনুতপ্ত হওয়া
মানুষ আল্লাহর অবাধ্য হয়ে নিজের প্রতি বা অন্যের অধিকার নষ্ট করে মানুষের প্রতি—যে প্রকারের জুলুমই করুক না কেন তার প্রথম প্রতিকার হলো অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। কোরআনে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার নিয়মও বাতলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁরা [আদম ও হাওয়া (আ.)] বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি, আপনি যদি ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ২৩)
যে জুলুমের প্রতিকারে তাওবা যথেষ্ট নয়
মানুষের প্রতি অবিচার করলে শুধু তাওবাই যথেষ্ট নয়; বরং জুলুমের শিকার ব্যক্তির অধিকার আদায় করা, তাকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং তার কাছে ক্ষমা চাওয়াও আবশ্যক। কেননা মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়, তার ভাইয়ের পক্ষে তার আমলনামা থেকে পুণ্য কেটে নেওয়ার আগেই। কারণ সেখানে কোনো দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) বা দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে তবে তার (মজলুম) ভাইয়ের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫৩৪)
লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিসি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
সূত্র-কালের কন্ঠ