‘অর্গানাইজড রোবারি’ থেকে আমাদের মুক্তি কবে?
:: প্রকাশ: ২০২০-০৩-১১ ০৮:২১:৪২
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি’ প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এবারো তারা তা দিয়েছে। এতে ১৩৫টি দেশের অর্থ পাচারের খবর আছে। গবেষণা নিবন্ধটির নাম ‘ট্রেড রিলেটেড ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজ ইন ওয়ান হানড্রেড থার্টি ফাইভ কান্ট্রিজ: ২০০৮-১৭’। অর্থাৎ এ গবেষণায় ১০ বছরের তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৭ সাল বাদে বাকি সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫ হাজার ২৭৩ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। কীভাবে? ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকের মাধ্যমে কীভাবে হয়, যেখানে এত আইন-কানুন চালু আছে? এ আইন-কানুন-নিয়মের মধ্যেই ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থ পাচারের অপকর্মটি সংঘটিত হয়েছে। কারা কারা জড়িত?
অবশ্যই দেশীয় ব্যাংক ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংক জড়িত। বিশেষ করে জড়িত যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের আমদানি-রফতানি ব্যবসা আছে। আমদানি-রফতানি ব্যবসা আছে প্রায় সব দেশের সঙ্গে। আমদানি করি আমরা সবচেয়ে বেশি চীন থেকে, তারপর ভারত থেকে। আর রফতানি করি ইউরোপীয় দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশে সবচেয়ে বেশি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করি তেল। তাহলে কি বলা যায়, ওইসব দেশের ব্যাংক আমাদের দেশের নাগরিকদের অর্থ পাচার অপকর্মে সহায়তা করছে? এ প্রশ্নের পর প্রশ্ন আছে আরেকটি। অর্থ পাচারের সঙ্গে কারা জড়িত? গবেষণায় যেহেতু ব্যাংকের কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে ব্যবসার কথা, পণ্যের অতিমূল্যায়নের কথা এবং পণ্যের অবমূল্যায়নের কথা, অতএব বলাই যায়, এতে জড়িত একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সহযোগী শক্তি হিসেবে যোগ দিচ্ছে নিশ্চয়ই অসাধু কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী একশ্রেণীর লোক। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী লোকজন নিশ্চয়ই জড়িত এ ঘটনায়। বলা যায়, বিরাট এক ‘নেটওয়ার্ক’। এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। পাচারে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছে দেশীয় ব্যাংক ও বিদেশী ব্যাংক। এটা হচ্ছে আইনের মধ্যেই। আইন মেনেই ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলছেন। বন্দর দিয়ে আইন মেনেই তারা পণ্য আনছেন। আইন মেনেই তারা রফতানিকারকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করছেন। আমাদের ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ অ্যাক্ট’ বলে যে আইনটি আছে তা মেনেই ঋণপত্র খোলা হয়েছে, টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আবার বিপরীতে আইন মেনেই, নিয়ম মেনেই পণ্য রফতানি করা হয়েছে। টাকা দেশে আনা হয়েছে। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে টাকা পরিশোধ করা এবং টাকা দেশে আনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটলে তার বিচার-আচারও চালু আছে। এসব ব্যতিক্রম বাদে বাকি সব আমদানি-রফতানি আইন-কানুন-নিয়ম-বিধি মেনে হচ্ছে। তা নিশ্চিত করছে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ।
ব্যাংক দেখছে একটা অংশ, কাস্টমস দেখছে আরেকটি দিক, আয়কর বিভাগ দেখছে অন্য একটা দিক। বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি-রফতানি ব্যবসা, আর্থিক লেনদেন, অর্থ পরিশোধ, অর্থ দেশে আনার কার্যক্রম তদারকি করছে। তাহলে প্রশ্ন, এতসবের মধ্যে কী করে অর্থ পাচার হয়? কী করে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একই ঘটনা ঘটে? কী করে এসব ঘটনা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে? তাহলে কি বলব, আইনের অধীনেই, আইন মেনেই ব্যাংকগুলো ‘ডাকাতিতে’ সহায়তা করছে, যাকে অনেক ব্যাংকার ‘অর্গানাইজড রোবারি’ বলে আখ্যায়িত করেন। এর অর্থ আইনের মধ্যে ডাকাতি। দেখা যায় শুধু অর্থ পাচার নয়, ঋণের টাকা মেরে দেয়ার ক্ষেত্রেও বহুক্ষেত্রে আইনের মধ্যেই তা করা হচ্ছে। ব্যাংক শাখা ঋণের প্রস্তাব পাঠায়, তাতে সুপারিশ থাকে। যাদের আঞ্চলিক অফিস আছে, সেসব ক্ষেত্রে আঞ্চলিক অফিস তা সুপারিশ সহকারে প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়। সংশ্লিষ্ট ঋণ বিভাগ তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। ‘কোলেটারেল’ ঠিক আছে কিনা, তা দেখেন ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবীরা, বন্ধকীকৃত সম্পত্তির মূল্যায়ন ঠিকমতো হয়েছে কিনা, তা দেখেন পেশাদার মূল্যায়নকারী। তারপর এ ঋণ প্রস্তাব ‘ক্রেডিট কমিটির’ কাছে যায়, যার প্রধান একজন সিনিয়র নির্বাহী। এর সদস্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরপর সংযুক্ত করা হয়েছে নিরীক্ষা বিভাগকে। তারা প্রস্তাবটি দেখবে। এরপর তা যাবে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে। তিনি ক্ষমতা থাকলে তা অনুমোদন বা ফেরত পাঠাবেন। ক্ষমতা না থাকলে তিনি সুপারিশ করে বোর্ডে পাঠাবেন। বোর্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী তা পাস অথবা ফেরত পাঠাবে।
এ প্রক্রিয়ায় বহু পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুপারিশ থাকে। এতসবের পর কী করে একটি লোনের টাকা ‘ডিফল্ট’ করে! অথবা লোনের টাকা লুট করা হয়! ব্যবসায়িক কারণের কথা আমরা জানি। এর বাইরেও ঘটছে শত শত ঘটনা। ৪ মার্চের খবর। দৈনিক বণিক বার্তার এ খবরের শিরোনাম: ‘ব্যাংকের ২৬৪ কোটি দেনা রেখে নব্য পোশাক ব্যবসায়ী উধাও’। শুধু এ খবর নয়, উধাও হওয়া সম্পর্কে চট্টগ্রাম শহরের অনেক ব্যবসায়ীর খবর আছে। ঢাকার ব্যবসায়ীদের খবর আছে। প্রশ্ন, এতসব নিয়ম-কানুন মেনে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন মেনে ঋণ দেয়ার পরও কী করে ঋণগ্রহীতারা টাকা মেরে দিচ্ছেন? এসবও কি ‘নিয়মের মধ্যে ডাকাতির’ ঘটনা নয়? এসবও কি ‘অর্গানাইজড রোবারি’ নয়? নয় কি ব্যাংক ডাকাতি? সাধারণ ডাকাতিতে ডাকাত অপরিচিত। তারা নিজেদের জানান না দিয়ে লোকের টাকা-পয়সা, সহায়-সম্পদ লুট করে। কিন্তু ব্যাংক ডাকাতি হচ্ছে আইনের মধ্যেই। নিয়ম-কানুন মেনেই। দেশের ভেতরে ব্যাংকের টাকা মারার ঘটনাটি যেমন আইন-কানুন মেনে হচ্ছে, অর্থ পাচারের ঘটনাটাও তা-ই। এখানে অবশ্য জড়িত শুধু দেশের ব্যাংক নয়, প্রায় সব আন্তর্জাতিক ব্যাংক। মাঝেমধ্যে দু-একটা ব্যাংক মানি লন্ডারিং আইনে দণ্ডিত হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় না। তাহলে কি আমরা বলব, ব্যাংকিং ব্যবস্থাটাই লুটেরাদের দখলে? তাহলে কি বলব, ব্যাংকগুলো আইনের মধ্যেই কিছুসংখ্যক লোককে নানাভাবে ধনাঢ্য করে, ধনাঢ্য হতে সহায়তা করে? এ প্রক্রিয়ায় অবশ্যই সরকার সহায়ক শক্তি। বস্তুত দেখা যায়, আন্তর্জাতিক ব্যাংক ব্যবস্থা লুণ্ঠনের একটা হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
ব্যাংকগুলো এ প্রক্রিয়ায় ধনীকে আরো ধনী করছে। তারা এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বৈষম্য তৈরি করছে। দেশীয়ভাবে তারা বৈষম্য তৈরি করছে। দেশের একটি অংশে তারা অপরিমিত ঋণ দিচ্ছে, অন্যত্র তারা কোনো ঋণ দেয় না। এক জায়গা থেকে আমানত সংগ্রহ করে তারা ঋণ দিচ্ছে অন্যত্র। সব এলাকার উন্নয়নে তারা সহায়তা করছে না। তারা বড়কে আরো বড় হতে ঋণ দিচ্ছে। বড় বড় কাস্টমার যা ঋণ চান, তা-ই দেয়া হচ্ছে। ছোট ও মাঝারি গ্রাহকরা ঋণ পান না। রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া নতুন উদ্যোক্তারা ব্যাংকে ঢুকতে পারেন না। কোনো একটা খাতে ঋণ দিতে শুরু করলে সবাই সেই খাতে ঢুকে অর্থনীতিতে একটা ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে। এ সমস্যা কি আজকের সমস্যা?
না, পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরও (১৯৪৭-৭১) তা আমরা লক্ষ করেছি। ব্যাংকগুলো ছিল ধনীদের হাতিয়ার। ২২টি পাকিস্তানি অবাঙালি পরিবার নিয়ন্ত্রণ করত পাকিস্তানের অর্থনীতি। ব্যাংকগুলোও ছিল তাদের হাতে। তারা পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আমানত সংগ্রহ করে সেই টাকায় ঋণ দিত পশ্চিম পাকিস্তানে। তখনো ব্যাংকগুলোয় আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং চালু ছিল। হরহামেশাই আমরা তা আলোচনা করেছি। কী করে ২২ পরিবার এসব কাণ্ড করছে তা ছিল আলোচ্য বিষয়। ব্যাংক ডাকাতির সমালোচনায় আমরা ছিলাম সোচ্চার। ওই ডাকাতিতে জড়িত ছিল ‘পশ্চিম পাকিস্তানিরা’ (বর্তমান পাকিস্তান)।
এসব অবিচার, শোষণ, অত্যাচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে করতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও পরে স্বাধীনতা। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই একই কাণ্ড ঘটে চলেছে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ব্যাংকগুলো হয়ে উঠেছে শোষণের হাতিয়ার, ডাকাতির হাতিয়ার, অর্থ পাচারের হাতিয়ার, বৈষম্য তৈরির হাতিয়ার। এই অর্গানাইজড রোবারি বা ‘নিয়মের অধীনে ডাকাতি’ থেকে আমাদের মুক্তি কবে হবে?
ড. আরএম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক