প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে প্রাণহানি অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রবিবার বিকাল পর্যন্ত বিশ্বে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৬৩ হাজার ৩৩২ এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮৬ জনে। আইসিইউতে আছে ৫ হাজার ৬৫৫ জন। এর মধ্যে গতকাল ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ২৬৩ জন। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ইউরোপের দেশগুলো। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইউরোপকে বর্তমানে করোনা ভাইরাস মহামারীর কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আলজাজিরার তথ্য অনুযায়ী করোনার কারণে ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুই দেশ ইতালি ও স্পেন। ইতালির সিভিল প্রটেকশন অথরিটি জানিয়েছে, সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মারা গেছেন ৩৬৮ জন। এ নিয়ে করোনার সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগে দেশটিতে মোট ২৪ হাজার ৭৪৭ জন আক্রান্ত ও ১ হাজার ৮০৯ জন প্রাণ হারালেন।
গতকাল এ রোগে ইতালিতে মারা যান দেশটির বেরগামো প্রদেশের সিনি শহরের মেয়র জর্জিও ভালোতি। ইতালির পরই ইউরোপে সঙ্গিন অবস্থা পার্শ্ববর্তী দেশ স্পেনের। গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৫৩ জনে, আর মারা গেছেন ২৯১ জন। এর মধ্যে গতকাল ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯৫ জন। পরিস্থিতি বিবেচনায় গোটা স্পেনে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা জারি করেছে সরকার।
এ ক’দিন দেশটির ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে। খাবার, ওষুধ ও জরুরি জিনিসপত্র কেনা ছাড়া কোনো কারণে বাইরে যাওয়া যাবে না। খাদ্য ও ওষুধ ছাড়া অন্য কোনো দোকানও খোলা রাখা নিষেধ। এর আগে করোনা পরিস্থিতির কারণে গোটা ইতালিকে অবরুদ্ধ অঞ্চল ঘোষণা করে দেশটির সরকার। ফলে দেশটির ২০ রাজ্যের সব মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেনটাইনে থাকতে হচ্ছে।
গত শনিবার এক টেলিভিশন ভাষণে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেন, ‘আমরা অচিরেই কাজকর্মে ফিরে যাব এবং বন্ধু ও প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করব। তবে সে সময় আসার আগ পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে।’ সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, শনিবার থেকেই দেশটির সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জাদুঘর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, স্টেডিয়াম, সিনেমা হল, পানশালাগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে রেস্তোরাঁগুলো শুধু কাস্টমারদের পার্সেল খাবার সরবরাহ করতে পারবে। তবে ব্যাংক ও পেট্রল স্টেশনের মতো জরুরি সেবা সংস্থা খোলা থাকবে। এর আগে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী সানচেজের স্ত্রী বেগোনা গোমেজ কোভিড-১৯ আক্রান্ত বলে খবর পাওয়া যায়।
করোনার কারণে ইউরোপের আরেক দেশ ফ্রান্সেও জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। ৬ কোটি ৩৫ লাখ মানুষের দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৪৯৯ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছেন ৯১ জন। শনিবার গ্রিনিচ মান সময় রাত ১১টায় শুরু হওয়া নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, সিনেমা হল, নাইট ক্লাব এবং কম জরুরি সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবে খাবার ও জরুরি ওষুধের দোকান ও পেট্রল স্টেশন থাকবে নিষেধাজ্ঞার বাইরে। বাতিল করা হয়েছে দেশটির স্থানীয় সরকার নির্বাচনও। শনিবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড ফিলিপ এ ঘোষণা দেন।
ব্রিটেনেও গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। সেখানে মোট আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৩৭২ জন, মারা গেছেন ৩৫ জন। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় সেখানে প্রাণ গেছে ১৪ জনের। এ ছাড়া গতকাল পর্যন্ত ইউরোপে নেদারল্যান্ডসে ৮, জার্মানিতে ২, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, হাঙ্গেরিতে একজন করে মারা গেছেন।
ইউরোপের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানে গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১১৩ জন। এ নিয়ে দেশটিতে মোট আক্রান্ত ১৩ হাজার ৯৩৮ জন ও মারা গেছেন ৭২৪ জন। ক্রমেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় করোনা মোকাবিলায় বিশ্ববাসীর সহায়তা চেয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। এক খোলা চিঠিতে রুহানি বলেন, ‘এ রোগ মোকাবিলার কাজ নির্বিঘ্ন করতে ইরানসহ বিভিন্ন দেশের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক যৌথ প্রটোকল স্বাক্ষর করতে হবে।’
এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও চলছে আতঙ্ক। কাজাখস্তানে গতকাল জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে দেশটির প্রেসিডেন্ট কাসয়াম-জোমার্ত তোকায়েভ। ভারতেও গত ২৪ ঘণ্টায় একলাফে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১০৭ জনে দাঁড়িয়েছে। কোভিড-১৯ রোগে এখন পর্যন্ত দেশটিতে মারা গেছে ২ জন। আক্রান্তের সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্য মহারাষ্ট্র। সেখানে ৩১ জন আক্রান্তের সন্ধান মিলেছে।
এর পরই ২২ জন আক্রান্ত রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায়। পরিস্থিতির কারণে এরই মধ্যে রাজধানী দিল্লিসহ একাধিক শহরে জারি রয়েছে জরুরি সতর্কতা। বন্ধ রাখা হয়েছে স্কুল-কলেজ, মার্কেট ও সিনেমা হল।
এ ছাড়া গতকাল পর্যন্ত করোনার উৎসস্থল চীনে ১০, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩, ফিলিপাইনে ৩, যুক্তরাষ্ট্রে ৫, অস্ট্রেলিয়ায় ২, জাপানে ২ ও আলজেরিয়ায় একজন প্রাণ হারিয়েছেন। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জারি করা হয়েছে রাত্রিকালীন কারফিউ।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস