ডা. জাহেদ উর রহমান:
মিডিয়ার মাধ্যমে এ দেশের ‘সংবিধান বিশেষজ্ঞ’ বলে কিছু মানুষকে আমাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এরই মধ্য দিয়ে এক ধরনের ভ্রান্তি মানুষের মধ্যে তৈরি হয় যে, সংবিধান বস্তুটা শুধু কিছু আইনজীবীর জন্য লেখা হয়েছে এবং কিছু মানুষ সেটার ওপর নানা রকম পড়াশোনা করে হয়ে উঠবেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। আমরা যারা আইনজীবী বা আইনজ্ঞ নই তারা সংবিধান নামক এ ‘ভয়ংকর কঠিন’ বস্তু থেকে তেমন কিছুই বুঝতে পারব না।
অথচ এ দেশের শিক্ষিত নাগরিকদের অন্তত বোঝা উচিত সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের মৌলিক আইন। এটি রাষ্ট্রের সঙ্গে তার নাগরিকের চুক্তি। কোনো রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা কোনো নাগরিক সেই রাষ্ট্র মানুক বা না মানুক, এমনকি ব্যক্তিগতভাবে হোক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে আস্থাহীন কোনো অ্যানার্কিস্ট, তবুও তাকে এ চুক্তির অধীন থাকতে হয়।
সেই কারণেই প্রত্যেক নাগরিকের উচিত সংবিধান সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা রাখা। তাতে কারও পক্ষে সংবিধানের দোহাই দিয়ে যাচ্ছেতাই বলে ফেলা সহজ হয় না। আমরা যে কেউ তখন ‘সংবিধান বিশেষজ্ঞ’দের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বোঝাবুঝিটা জানিয়ে দিতে পারি।
নাগরিকদেরই যদি এটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে থাকে তাহলে সংবিধান সম্পর্কে স্পষ্ট এবং দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আইন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাজনীতিবিদদের অনেক বেশি থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে এর ভীষণ অভাব। তার এক প্রদর্শনী হল দু’দিন আগে।
এ দেশের কিছু সাধারণ মানুষের সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক নেতা করোনা মোকাবেলায় জরুরি অবস্থা জারির আহ্বান জানাচ্ছেন। বুঝে এটি জানিয়েছেন বলাটা ঠিক হবে না। কারণ, বুঝলে এ আহ্বান তারা জানাতেন বলে আমি বিশ্বাস করি না।
নিশ্চয়ই সংবিধানে জরুরি আইন জারি করার বিধান আছে। দেখে নেয়া যাক এ সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ ১৪১ক(১) : রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে, যাহাতে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা উহার যে কোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহা হইলে তিনি ৯০ দিনের জন্য (অনধিক একশত কুড়ি) জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিতে পারিবে।
যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণের পরিস্থিতি না থাকলেও অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা এর যে কোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা দেখলে জরুরি অবস্থা জারি করার সাংবিধানিক ভিত্তি আছে।
সেই বিবেচনায় বর্তমানের করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা জারি করা সম্ভব। কিন্তু সেটা কি প্রয়োজনীয়? জরুরি অবস্থা ছাড়া কি করোনা মোকাবেলা করা যাবে না?
জরুরি আইন জারির ফলে কোন বিধানটি থাকার ফলে করোনা মোকাবেলায় সুবিধা হবে? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগে জরুরি অবস্থা জারি নিয়ে সংবিধানে কী আছে, সেটা একটু দেখে নেয়া যাক।
১৪১খ : এই সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অন্তর্গত বিধানাবলীর কারণে রাষ্ট্র যে আইন প্রণয়ন করিতে ও নির্বাহী ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে সক্ষম নহেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার কার্যকরতাকালে এই সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ অনুচ্ছেদসমূহের কোনো কিছুই সেইরূপ আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কিত রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করিবে না।
অর্থাৎ জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষেত্রে সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলোর পরিপন্থী পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার যাতে বাধা না পায় সেটার নিশ্চয়তা দেয়া আছে।
ওই ধারাগুলোতে আছে যথাক্রমে চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার।
খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন করোনা কোভিড-১৯ ঠেকাতে এসব কোনো কোনো মৌলিক অধিকার বন্ধ রাখতে হতে পারে। এসব বন্ধ করার জন্য কি জরুরি অবস্থা জারির কোনো প্রয়োজন আছে?
সরকার কি এরই মধ্যে সবরকম ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি? সরকার কি ঠিকভাবে কোয়ারেন্টিনে না থাকা মানুষদের ওপরে শাস্তির বিধান আরোপ করেনি? সরকার কি কিছু এলাকা লকডাউন করার মাধ্যমে মানুষের চলাফেরার মতো মৌলিক অধিকারও বন্ধ করেনি?
সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এই ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষমতা দিয়েছে সরকারকে। স্বাভাবিকভাবেই ২০১৮ সালে তৈরি করা আইনে নতুন করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯-এর উল্লেখ নেই।
কিন্তু আইনের ৪ ধারায় উল্লিখিত ২৩টি রোগের নামের পর আছে এটা-৪(ভ) সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ঘোষিত কোনো নবোদ্ভূত বা পুনরুদ্ভূত (Emerging or Reemerging) রোগগুলো। তাহলে শুধু একটা প্রজ্ঞাপনই যথেষ্ট করোনা ভাইরাসকে এই আইনের অধীন নিয়ে আসার জন্য।
করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কোনো পদক্ষেপ এই আইনের অধীনই নেয়া সম্ভব। আইনের ৯ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক দেয়া যে কোনো নির্দেশনা এই আইনের অধীন বাস্তবায়ন করা যাবে।
এই আইনের ১১ থেকে ২০ ধারায় বর্ণিত পদক্ষেপগুলো আন্তরিকভাবে নেয়া হলে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সরকারের ন্যূনতম কোনো সমস্যা হওয়ার কারণ নেই।
এখানে হাসপাতালে যে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার, মানুষের চলাচলে বাধা, মানুষকে কোয়ারেন্টিন করা, যে কোনো স্থানে গিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে পারা, এমনকি কোনো স্থাপনা পরিপূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব না হলে সেটা ভেঙে ফেলার আদেশ দেয়ার ক্ষমতাও সরকারকে দেয়া আছে (ধারা ১৭)।
করোনার এই সময়ে আরেকটা সমস্যা আছে- চারপাশে নানা গুজব। সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা যে কোনো বিষয়ে গুজবের জন্য প্রধানত দায়ী করেন কোনো রাষ্ট্রে ক্ষমতায় থাকা মানুষদের।
কোনো সরকার যখন কোনো ব্যাপারে নিজে স্বচ্ছ হয় না বরং তথ্য চাপা রেখে একটা রুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে তখন গুজবের সৃষ্টি হয়। শুধু সরকার স্বচ্ছ হলেই গুজব আর ডালপালা মেলে না।
তারপরও যদি বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয় যেটা করোনাকে সামাল দিতে সমস্যা তৈরি করবে, সেটা ঠেকানোর জন্য তো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টই আছে।
তাহলে করোনা ঠেকানোর জন্য সব ব্যবস্থা নেয়ার আইনি ক্ষমতা প্রচলিত আইনে যখন আছে তখন জরুরি অবস্থা জারির কথা আসছে কেন?
জরুরি অবস্থা সরকারের হাতে আরেকটা খুব বড় অস্ত্র তুলে দেয়। সেটা বলা আছে ১৪১গ(১) অনুচ্ছেদে। দেখে নেয়া যাক সেটা জরুরী অবস্থা ঘোষণার (কার্যকরতাকালে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি) আদেশের দ্বারা ঘোষণা করিতে পারিবেন যে, আদেশে উল্লিখিত এবং সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অন্তর্গত মৌলিক অধিকারগুলো বলবৎকরণের জন্য আদালতে মামলা রুজু করিবার অধিকার এবং আদেশে অনুরূপভাবে উল্লিখিত কোনো অধিকার বলবৎকরণের জন্য কোনো আদালতে বিবেচনাধীন সব মামলা জরুরি অবস্থা ঘোষণার কার্যকরতাকালে কিংবা ওই আদেশের দ্বারা নির্ধারিত স্বল্পতর কালের জন্য স্থগিত থাকিবে।
সরকারের হাতে জরুরি অবস্থার ‘মূল মজা’ আসলে এখানে। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করে দিলেও দীর্ঘমেয়াদে জরুরি অবস্থা দিয়ে রেখেছিল শুধু মানুষকে তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রিট করা থেকে বিরত রাখার জন্য। তাহলে এই মুহূর্তে জরুরি অবস্থা জারি করে সরকারের হাতে এই অস্ত্র তুলে দিতে কেন চাইছে কেউ কেউ?
করোনা নিয়ে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে মানুষ সংক্ষুব্ধ ছিল। যখন সরকার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে তখন মানুষ হাইকোর্টে রিট করতে যাওয়া দূরে থাকুক তাকে সাধুবাদ জানিয়েছে।
ওয়াশিংটন এবং দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর ডিজিজ, ডিনামিক্স, ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসির পরিচালক ড. রামানান লাক্সমিনারায়ানান বিবিসিকে বলেছেন, ভারত হবে করোনাভাইরাস মহামারীর পরবর্তী ‘হট-স্পট’ এবং দেশটিকে অতি জরুরি ভিত্তিতে ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সুনামির’ জন্য প্রস্তুত হতে হবে। অর্থাৎ ভারতে করোনা নিয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি।
ভারতীয় সংবিধানের তিনটি ভিন্ন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিন ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান আছে। এর মধ্যে ৩৫২ ধারায় বর্ণিত জাতীয় জরুরি অবস্থা আমাদের সংবিধানে বর্ণিত পরিস্থিতির সঙ্গে পুরোপুরি মিল আছে।
প্রাসঙ্গিকভাবে জানিয়ে রাখি, এই অনুচ্ছেদের অধীনই দু’বার বহিঃশত্রু চীন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ১৯৬২ এবং ১৯৭১ সালে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।
আর আরেকবার ইন্দিরা গান্ধী অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ছুতো দেখিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, যা চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছিল। আগের অনুচ্ছেদেই দেখানো ভারতের করোনা সংক্রমণের এই ভয়ংকর পরিস্থিতি সামনে রেখে কেউ তো বলছে না ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে।
চীন অফিশিয়ালি করোনার অস্তিত্ব স্বীকার করার পর বাংলাদেশের সেটি স্বীকার করার মধ্যে নয় সপ্তাহের ব্যবধান ছিল। এই সময়ের মধ্যে অনেক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি ছিল, যেগুলো বাংলাদেশ সরকার সেভাবে নেয়নি।
এখন সরকার একটা জরুরি অবস্থা জারি করলেই সব পদক্ষেপ নিজের মতো নিতে শুরু করবে এটা ভাবা হাস্যকর, বরং এতে এখনও করোনা নিয়ে মানুষ সামাজিক মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ কথা বলে যতটুকু চাপ জারি রেখেছে, এমনকি উচ্চ আদালতও কারোনা মোকাবেলায় সরকারের নানা গাফিলতি নিয়ে যেসব রায় ও পর্যবেক্ষণ দিচ্ছেন সেটাও নষ্ট হবে। করোনা নিয়ে এক ধরনের ‘ইনফরমেশন ব্ল্যাকআউট’-এর মধ্যেই হয়েছে, জরুরি অবস্থা জারি হলে সেটার ষোলোকলা পূর্ণ হবে।
আগেই উল্লেখ করেছি, করোনা মহামারী মোকাবেলা করার জন্য সবরকম পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা বিদ্যমান আইনেই আছে। এমনকি এটা মোকাবেলার সব দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়াও বিদ্যমান আইনি কাঠামোতেই সম্ভব।
তারপরও বিশেষ কোনো পদক্ষেপের আইনি ভিত্তির প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমেই সেটি সম্ভব যেটি পরবর্তী সময়ে সংসদে পাস করে নিলেই হবে। তাই জরুরি অবস্থা জারির আহ্বান দূরে থাকুক, সরকার জরুরি অবস্থা জারির পরিকল্পনা করলে সেটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য প্রস্তুত থাকুন। কারও সংশয় থাকলেও জরুরি অবস্থা নিয়ে আরও পড়াশোনা করুন, জানুন। হোক সেটি প্রাণঘাতী করোনা কিংবা চরম কর্তৃত্ববাদী সরকার, উভয় ক্ষেত্রেই ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’। ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট
সানবিডি/ঢাকা/এসএস