১৮ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যা। ফ্রান্সের ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম। জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ড সীমান্ত লাগোয়া এক লাখের বেশি মানুষের শহর ফ্রান্সের মুলহাউসের এই গির্জায় সপ্তাহব্যাপী এক ধর্মীয় উপাসনায় অংশ নিয়েছেন হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষ। প্রত্যেক বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারও মানুষ এই গির্জায় বহুল আকাঙ্ক্ষিত উপাসনায় অংশ নেন।
এবার এই উপাসনায় অংশ নেয়া কেউ একজন করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেছিলেন। মুলহাউসের স্থানীয় সরকার বলছে, করোনার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে এই গির্জার ধর্মীয় সেই উপাসনা অনুষ্ঠানের সম্পর্ক রয়েছে। এই গির্জায় গিয়েছিলেন এমন আড়াই হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।
ফ্রান্সের মুলহাউসের ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জা থেকে এই ভাইরাস এখন ছড়িয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার বুর্কিনা ফাঁসো থেকে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ কর্সিকা, লাতিন আমেরিকার গায়ানা থেকে সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্সের পারমাণবিক পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ইউরোপের বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারক মার্সিডিজ-বেঞ্জের কারখানায়ও।
ধর্মীয় ওই অনুষ্ঠানের কয়েক সপ্তাহ পর ফ্রান্সের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় জার্মানি। একই সঙ্গে গত ২৫ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই দেশের নাগরিকদের অবাধ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জার্মানি। গির্জার ওই ঘটনার কারণেই জার্মানি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট দুটি সূত্র রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছে।
গির্জার কর্মকর্তারা বলেছেন, গির্জাটির সমাবেশে অংশ নেয়াদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৭ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
একই ধরনের একটি ধর্মীয় সমাবেশ থেকে করোনাভাইরাস বিস্তারের ঘটনা আছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশটির দায়েগু শহরের একটি গির্জায় অংশ নিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। সেখানে শুধু একজন নারী করোনা সংক্রমিত জানার পরও চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ উপেক্ষা করে গির্জার সমাবেশে গিয়েছিলেন। পরে তার মাধ্যমে গির্জায় আসা ৫ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হন।
ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা রয়টার্সকে যে গল্পটি বলেছেন তাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের গতি এবং নাজুক পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে। ফ্রান্সের ওই অঞ্চলের স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এখনও এই সংক্রমণ মোকাবিলার প্রস্তুতি পর্বে রয়েছেন।
ফ্রান্সে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ হাজার ১৭৪ এবং মারা গেছেন ২ হাজার ৬০৬ জন। উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মতো ফ্রান্সের সরকারও বড় ধরনের জনসমাবেশ কিংবা মানুষের অবাধ চলাচলের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেনি।
যে কারণে ওই গির্জার সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের জন্য কোনও হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেনি কর্তৃপক্ষ। গির্জাটির প্রতিষ্ঠাতার নাতি এবং বর্তমান প্রধান যাজক জোনাথন পিটার্সমিট বলেন, সেই সময় আমরা কোভিড-১৯ কে খুব দূরের কিছু মনে করেছিলাম। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় পিটার্সমিটের বাবা স্যামুয়েলের সাক্ষাৎকার নিতে পারেনি রয়টার্স।
এই গির্জার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রথম করোনা রোগী পাওয়া যায় ২৯ ফেব্রুয়ারি। এরপর দেশটির জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এই গির্জায় আগতদের ও তাদের সংস্পর্শে আসাদের শনাক্ত করতে দীর্ঘ অনুসন্ধান শুরু করেন। কিন্তু তার আগেই গির্জায় আগতরা দেশটির বিভিন্ন প্রান্ত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন।
গির্জা কর্তৃপক্ষ উপাসনায় অংশগ্রহণকারীদের একটি তালিকা দেশটির স্বাস্থ্যবিভাগের কাছে দিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিভাগের তদন্তকারীরা বলছেন, বেশ দেরি হয়ে গেছে। ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলের জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থার মহামারি বিশেষজ্ঞ মাইকেল ভার্নি বলেন, গির্জায় শিশুদের দেখাশোনা যারা করেন, ইতিমধ্যে তাদের অনেকেই করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা হেরে গিয়েছি। আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের সামনে এখন করোনার টাইম বোমা অপেক্ষা করছে।
গির্জার সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের একজন স্থানীয় বাসিন্দা এলি উইদমার। একটি গৃহ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ৩৭ বছর বয়সী এই ব্যাবস্থাপক বলেন, তার বাবা-মা এই গির্জার সদস্য ছিলেন। ১৯৬৬ সালে গির্জাটি নির্মাণ করেছিলেন জিন পিটার্সমিট নামের এক ব্যবসায়ী। একদিন হঠাৎ করেই তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে ওই দোকানি যীশু খ্রিস্টের বাণী প্রচার করলে স্ত্রী সুস্থ হয়ে যান বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এর পরপরই যীশুর বাণী প্রচারের জন্য গির্জাটি প্রতিষ্ঠা করেন জিন।
এলি উইদমার বলেন, কিশোর বয়সে এই গির্জা থেকে দূরে ছিলেন তিনি, কিন্তু বর্তমানে আবারও সেখানে যাতায়াত শুরু করেছেন। মুলহাউসের এই গির্জার বাৎসরিক এই সমাবেশের জন্য অনেকেই পুরো বছর ধরে অপেক্ষা করেন। তিনি বলেন, এই সপ্তাহে সেখানে গেলে আপনি বিশেষ শক্তি অনুভব করবেন। আধ্যাত্মিক এই শক্তি অর্জনের জন্য আপনি সবকিছু এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেবেন। এই গির্জার বাদক দলের ড্রামার হিসাবে সেখানে পুরো সপ্তাহজুড়ে থাকেন এলি।
ভূ-মধ্যসাগরীয় দ্বীপ কর্সিকা থেকে এই সমাবেশে এসেছিলেন ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা অ্যান্টইনিত্তে। গত ২৫ বছর ধরে তিনি মুলহাউসের ওই গির্জার সপ্তাহব্যাপি ধর্মীয় সমাবেশে আসেন। এ বছর পরিচিত আরও পাঁচ নারীকে নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জায় এসেছিলেন তিনি। গির্জায় অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে এমন কথা বাইরের লোকজন বললেও তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন সেখানে আগত লোকজন- নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন অ্যান্টইনিত্তের এক সঙ্গী।
বুর্কিনা ফাসোর রাজধানী ওয়াগাদোগু থেকে এয়ার ফ্রান্সের একটি ফ্লাইটে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে যান মামাদো কারামবিরি। নিজ দেশের একটি গির্জার যাজক তিনি। চমৎকার বক্তা হিসেবে সুপরিচিত সাদা চুলের এই যাজক ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জার তারকা যাজকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
রাজধানী ওয়াগাদোগুতে মামাদো কারামবিরির গির্জাটি একটি গুদামের মতো; যেখানে ১২ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা আছে। নিরাপত্তারক্ষী এবং স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সের মুলহাউসে গিয়েছিলেন মামাদো কারামবিরি। কারামবিরি দেশে ফেরার পর তার গির্জায় উপাসনায় অংশ নিয়েছিলেন; পরে সেখানকার ১২ জন করোনায় সংক্রমিত হন।
মুলহাউসের ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জার পাশে চারতলা বিশিষ্ট একটি ক্যাফে রয়েছে। গির্জায় আগত ব্যক্তিরা সেখানে একসঙ্গে একই প্লেটে খাবার সাড়েন। দুই সন্তানকে নিয়ে গির্জার উপাসনায় গিয়েছিলেন এক নারী। পরেই দুই সন্তান-সহ তিনিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যাজক জোনাথন পিটার্সমিট বলেন, গির্জায় সপ্তাব্যাপি উপাসনার প্রত্যেকদিন গড়ে আড়াই হাজারের বেশি মানুষ অংশ নেন। দিনের পর দিন সেখানে অসংখ্য মানুষ আসেন এবং সময় কাটান।
ভাইরাসের বিস্তার
ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে গির্জার ড্রামার এলি উইদমার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার স্ত্রী, তিন সন্তান এবং শাশুড়িও অসুস্থ হন। গত ৩ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ফ্রান্সে মোট ১৯১ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ ঘটনার পর গির্জা কর্তৃপক্ষ ফেসবুকে এক পোস্টে গির্জায় আগতদের সবাইকে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেয়।
উইদমার ফ্রান্সের জরুরি নম্বর ১৫ ডায়াল করেন চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য। কিন্তু তাকে পরীক্ষা করানোর মতো কিট বলে জানানো হয়। তবে চিকিৎসকরা তাকে করোনা রোগী হিসেবে চিকিৎসা দেন এবং পরিবার-সহ কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ পান তিনি।
তিনদিনের প্রচন্ড জ্বর এবং মাথা ব্যথার সঙ্গে মুখের স্বাদ হারিয়ে ফেলেন উইদমার। তবে এটা নিয়ে বিশেষ কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না তার। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের মাঝে মৃদু উপসর্গ রয়েছে। উইদমার সুস্থ হয়ে উঠলেও তার পরিবারের সদস্যরা এখনও আইসোলেশনে আছেন। গির্জার প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের সদস্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। তবে তাদের মধ্যে এক ডজনের বেশি সদস্য ইতিমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল দূরে বসে জার্মান কর্মকর্তারা ক্রমবর্ধমান এই শঙ্কা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। প্রত্যেকদিন গড়ে ৪৫ হাজার ফরাসী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জার্মানিতে আসেন। তারা জার্মানিতে পোরশে এবং মার্সিডিজ-বেঞ্জের কারখানায় কাজ করেন। এই কারখানার কিছু শ্রমিক মুলহাউসের সেই গির্জায় গিয়েছিলেন। পরে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন করোনা সংক্রমিত হন।
মুলহাউসের কাছে ফ্রান্সের পারমাণবিক পাওয়ার প্ল্যান্টের একজন কমী গির্জার সমাবেশে গিয়েছিলেন; পরে তিনিও করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন। তড়িঘড়ি করে জার্মান কর্তৃপক্ষ ফ্রান্সের সঙ্গে আংশিক সীমান্ত বন্ধ করে দেয়।
অ্যান্টইনিত্তের গল্পে ফেরা যাক
গির্জার উপাসনা শেষে ভূমধ্যসাগরীয় কর্সিকা দ্বীপের বাসিন্দা অ্যান্টইনিত্তে বাসায় ফেরেন। ফেরার ৯দিন পর মুলহাউস কর্তৃপক্ষ তাকে টেলিফোনে গির্জা থেকে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে বলে জানায়।
সেই রাতেই তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। এই দ্বীপের বাসিন্দা হিসেবে অ্যান্টইনিত্তে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন। তখন থেকেই আইসোলেশনে আছেন তিনি। ২৭ মার্চ পর্যন্ত কর্সিয়া দ্বীপে ২৬৩ জন করোনা সংক্রমিত হয়েছেন; যাদের ২১ জন মারা গেছেন।
অ্যান্টইনিত্তে বলেন, মানুষ এখন করোনার বিস্তারের জন্য আমার দিকে আঙুল তুলছে। তাদের একটি বলির পাঠা দরকার। এই দ্বীপের বাসিন্দারা করোনাভাইরাসকে বহন করে নিয়ে আসার জন্য মুলহাউসের গির্জা থেকে ফেরা অ্যান্টইনিত্তেকে দায়ী করছেন।
২০ মার্চ ফ্রান্সে করোনা রোগীর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। যাদের অধিকাংশই মুলহাউসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ভার্নি বলেন, আক্রান্তদের বেশিরভাগের সঙ্গে মুলহাউসের গির্জার যোগসূত্র রয়েছে।
করোনার চিকিৎসা সরঞ্জাম ও আইসিইউ শয্যার অভাবে কিছু রোগীকে হেলিকপ্টারে করে সুইজাল্যান্ড, জার্মানি এবং লুক্সেমবার্গে নেয়া হয়েছে। রোগীদের চিকিৎসায় খোলা আকাশের নিচে নতুন করে হাসপাতাল নির্মাণ করেছে ফরাসী সেনাবাহিনী।
বুর্কিনা ফাসোর পাদ্রী মামাদো কারামবিরির গল্প
রাজধানী ওয়াগাদোগুর পাদ্রী কারামবিরি পরিবার ও নিরাপত্তারক্ষীসহ দেশে ফেরার পর ১ মার্চ অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্থানীয় একটি ক্লিনিকে পরীক্ষায় তার শরীরে করোনার উপস্থিতি পাওয়া যায়। ২০ মার্চ পর্যন্ত পরিবারসহ কোয়ারেন্টাইনে যান তিনি।
পরে স্ত্রীকে পাশে নিয়ে ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় ভক্তদের উদ্দেশে নিজের করোনা সংক্রমিত হওয়ার খবর দেন তিনি। বিশ্বজুড়ে করোনার প্রাদুর্ভাবের ব্যাপারে মামাদো কারামবিরি বলেন, পৃথিবী ধ্বংস করার জন্য অনেক আগেই শয়তান এই পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমাদের দেখছেন। তিনিই এই দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করবেন।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস