প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে যাওয়া। কাজ শেষে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের ও পরিবারের নিত্যপ্রয়োজন মেটানো। পরের দিন আবার কাজের সন্ধানে ছোটা। এমন জীবনচক্রের মধ্যে থাকা শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা দেশে প্রায় দুই কোটি, যাদের নেই কোনো সঞ্চয়। বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের প্রথম আঘাতটা তাদের ওপরই এসেছে। কয়েক দিন ধরে কর্মহীন জীবন পার করছেন নিম্ন আয়ের এসব মানুষ।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। সবকিছু থমকে থাকায় কাজে বের হতে পারছেন না কুলি-মুটে, নির্মাণ ও আবাসন শ্রমিকসহ সব ধরনের দিনমজুর।
দেশে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। অনানুষ্ঠানিক খাতের বড় একটি অংশই দৈনিক, চুক্তিভিত্তিক মজুরি এবং নিয়োগপত্র ছাড়াই কাজ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রমিক কাজ করছেন মুদি কিংবা বিভিন্ন দোকানে। এর পাশাপাশি পরিবহন, বন্দর, নির্মাণ ও আবাসন এবং হাটবাজার শ্রমিক রয়েছেন। সব মিলিয়ে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন প্রায় দুই কোটি শ্রমিক, যারা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। এ অবস্থায় নিম্ন আয় ও খেটে হাওয়া মানুষ যাদের কিনা সঞ্চয় নেই, তাদের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে! পরিবর্তিত পরিস্থিতি কতদিন চলতে পারে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া প্রয়োজন। দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্য ও বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও যেন না থাকে, সেটি সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে। সব মিলিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ খুব দ্রুত গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে প্রায় ২ কোটি ৪২ লাখ মজুরি ও বেতনভোগী শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পান প্রায় ৮৩ লাখ ৩২ হাজার শ্রমিক। এছাড়া সাপ্তাহিক মজুরি পান ১৭ লাখ ৭২ হাজার শ্রমিক। সব মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ১ লাখ শ্রমিক দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মজুরি নিয়ে থাকেন। তবে এ তালিকায় আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত কিংবা পারিবারিক অর্থায়নে হেলপার হিসেবে যারা আছেন, তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে কৃষি খাতে প্রায় ৭২ লাখ ৯২ হাজার শ্রমিক রয়েছেন।
কৃষিশ্রমিক: বিবিএসের ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯২ হাজারের বেশি মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৮৭ লাখ ৬৫ হাজার ১০৭ জন বা প্রায় ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশই পারিবারিক হেলপার। এছাড়া স্ব-কর্মসংস্থান হয়েছে ৮১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৭ জনের বা প্রায় ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশের। আর কৃষিশ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন ৭২ লাখ ৯১ হাজার ৮৪০ জন বা প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্যভাবে নিয়োজিত রয়েছেন ১ লাখ ৬৮ হাজার শ্রমিক। তবে কৃষিকাজ কিছুটা চলমান থাকায় পুরোপুরি সবাই কর্মহীন হননি। যদিও প্রতিটি এলাকায় অধিকাংশ কৃষিশ্রমিকের অবস্থা খারাপ যাচ্ছে।
নির্মাণ ও আবাসন শ্রমিক: নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকাংশই সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কাজে যুক্ত হন। অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন বলে তাদের অধিকাংশের কোনো নিয়োগপত্র থাকে না। নির্মাণ প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকেন রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রি, সুপারভাইজার, টেকনিশিয়ান, ইলেকট্রিশিয়ান, মেশিন অপারেটর ও হেলপার কিংবা শাটার মিস্ত্রিরা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে তাদের প্রায় সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ বা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ফলে বেকার সময় পার করছেন নির্মাণ ও আবাসন খাতের প্রায় ৩৬ লাখ শ্রমিক।
মুদি ও চায়ের দোকান শ্রমিক: বিবিএসের তথ্যমতে, দেশের খুচরা ও পাইকারি পণ্যের দোকান এবং মোটর মেরামত খাতে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ৮৬ লাখ ৫৫ হাজার শ্রমিক। তাদের সিংহভাগই দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন। এর মধ্যে মুদি, চায়ের দোকান ও মোটর শ্রমিক বেশি। ২০১৮ সালে দেশে মুদি দোকানের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৬টি। এসব দোকানে কাজ করেন প্রায় ২৭ লাখ ৯৫ হাজার ৩৭০ জন মানুষ। এছাড়া প্রায় ৪ লাখ ৯১ হাজার ২৭৯টি চায়ের দোকানে কাজ করছেন প্রায় ১০ লাখ ৭৮ হাজার জন। অন্যদিকে দেশে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার তালিকাভুক্ত ফার্মেসি রয়েছে। এর বাইরে ছোট ও মাঝারি দোকান সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গড়ে দুজন করে ধরলে দুই লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে থাকেন এসব ফার্মেসিতে। স্বল্প পরিসরে খোলা থাকায় এ খাতের সবাই বেকার হয়ে পড়েননি। তবে শঙ্কার কারণে অধিকাংশই ছুটিতে রয়েছেন।
পরিবহন, গুদাম ও বন্দর শ্রমিক: দেশে বাস-মিনিবাস, ট্রাক-পিকআপ, অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, হিউম্যান হলারসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির যানবাহনে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেন এক বা একাধিক শ্রমিক। একজন চালকের সঙ্গে একজন সুপারভাইজার ও একজন সহকারী থাকেন। ২৬ হাজারের বেশি বাস-মিনিবাস, ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি ট্র্যাক-পিকআপ ছাড়াও সম্প্রতি রাইডশেয়ারের মাধ্যমে পরিবহন শ্রমিকরা কাজ করছেন। পাশাপাশি টিকিট কাউন্টার পরিচালনা, রুট পরিচালনাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকেন তারা। পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের হিসাবে, সারা দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা ৫২ লাখের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় ১২টি স্থলবন্দর চালু রয়েছে। এসব বন্দরে প্রত্যক্ষভাবে ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন। তবে পরোক্ষভাবে কাজ করছেন আরো প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। পরিবহন ও বন্দরগুলো বন্ধ থাকায় অধিকাংশ শ্রমিকের জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছে অন্ধকার।
সরকার কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য কাজ করছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বেশকিছু শ্রেণীর কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন অবস্থায় আছেন। সারা দেশে শহর ও গ্রামে ভিক্ষুক, ভবঘুরে, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানগাড়ি চালক, পরিবহন শ্রমিক, রেস্তোরাঁ শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, চায়ের দোকানদারসহ সংশ্লিষ্টদের তালিকা তৈরি করে খাদ্য সহায়তা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৪ মার্চ থেকেই আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে খাদ্য ও নগদ সহায়তা পাঠানো হয়েছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী তা প্রতিনিয়ত আপডেট করা হচ্ছে। ডিসিদের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হলে আশা করছি কেউ সহায়তার বাইরে থাকবেন না।
সানবিডি/এনজে