চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাতের রফতানি গন্তব্যে দেশগুলোর প্রায় সবকয়টিই এখন আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ লকডাউনে। একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতের পাশাপাশি নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশেও গত ২৬ মার্চ থেকে চলছে অঘোষিত লকডাউন। এ পরিস্থিতিতে রফতানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। পোশাক খাতের উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, মার্চে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের রফতানি কমেছে ২৭ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিজিএমইএ জানিয়েছে, মার্চে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ১৯৭ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ডলার মূল্যের। এর আগে গত বছরের একই সময়ে এ রফতানির পরিমাণ ছিল ২৬৯ কোটি ৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এ হিসাবে রফতানি কমেছে ৭১ কোটি ৮৩ লাখ ডলার বা ২৬ দশমিক ৭০ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, চীনের উহানে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় গত ডিসেম্বরের শেষে। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিতেও তৈরি পোশাকের রফতানি ছিল কমতির দিকে। এ ধারা অব্যাহত ছিল মার্চেও।
চীনে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর পর দেশটি থেকে কাঁচামাল আনতে পারছিলেন না তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদনকারীরা। কারণ করোনার প্রভাবে দেশটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম সে সময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে। ফলে শুরুতেই কাঁচামাল সরবরাহ সংকটে পড়ে যায় তৈরি পোশাক খাত। কারণ দেশের তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাপড়ের আনুমানিক ৬০ শতাংশই আমদানি হয় চীন থেকে। অন্যদিকে নিটওয়্যারের ক্ষেত্রে চীন থেকে কাঁচামাল আনতে হয় আনুমানিক ১৫-২০ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ধীরগতিতে হলেও কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু এ মুহূর্তে চাহিদা সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতকে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও আছে। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক প্রাইমার্কের পাশাপাশি ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করছে ইউরোপের ছোট-মাঝারি-বড় সব ধরনের ক্রেতাও। আবার এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, কিয়াবি, টার্গেট, পিভিএইচসহ আরো কিছু ক্রেতা ক্রয়াদেশ বহাল রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিতের পরিমাণ কমে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজিএমইএর তথ্য বলছে, গতকাল সকাল ৭টা পর্যন্ত ১ হাজার ১১৬ কারখানায় ৩০৫ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। এসব ক্রয়াদেশের আওতায় ছিল ৯৫ কোটি ৩০ লাখ পিস পোশাক। এসব কারখানার মোট শ্রমিক সংখ্যা ২১ লাখ ৯০ হাজার।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই পোশাক রফতানির পরিস্থিতি ছিল বেশ টালমাটাল। ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের বিক্রয় কেন্দ্রগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ প্রাপ্তির পরিমাণও ছিল তুলনামূলক কম। ক্রয়াদেশ যতটুকু পাওয়া যাচ্ছিল, তার দামও ছিল কম। এ প্রবণতা ইউরোপের বাজারগুলোতেই বেশি। আবার সেখানকার পোশাক ক্রেতাদের ভোক্তা আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে এখন অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটার প্রবণতা বাড়ছে। এ অবস্থায় দেশের পোশাক খাতের ওপর অনেক বড় একটি আঘাত হানল নভেল করোনাভাইরাস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, পোশাক রফতানি পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে পোশাক খাতের অবস্থা কতটা নাজুক। সংকট এখনো চলমান।
রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৩১ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল। সে সময় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পরের মাসেই বড় ধরনের পতন হয় পোশাক রফতানির। আগস্টের মধ্যে প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ঋণাত্মক ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশে। এরপর অক্টোবর ও নভেম্বরে এ প্রবৃদ্ধি আরো নেমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ঋণাত্মক ১৯ দশমিক ৭৯ ও ঋণাত্মক ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশে।
এরপর ডিসেম্বরে রফতানি আবার ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে। ওই মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। কিন্তু জানুয়ারি থেকে আবারো নেতিবাচক বা ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে তৈরি পোশাক খাত। ওই সময় রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এরপর ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রফতানি হয় ২৫৯ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের। যেখানে গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে পোশাক রফতানি ছিল ২৭৫ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার ডলারের। এ হিসেবে ফেব্রুয়ারিতেও পোশাক রফতানি হ্রাস পায় ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।