২০১৯ বছরে দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেও বিভিন্ন জেলায় ধান কাটার মৌসুমে কৃষি শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছিল। এ বছর নভেল করোনাভাইরাসের কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এ সংকট আরো তীব্র হবে। শ্রমিক সংকটে সময়মতো বোরো ধান কাটতে না পারলে প্রায় ১৯ লাখ ৪৫ হাজার টন চাল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) কৃষি অর্থনীতি বিভাগ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তির জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে ধান কর্তন মৌসুমে শ্রমিক সংকটের সম্ভাব্য এ হিসাব দিয়েছে ব্রি। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এবার দেশের ২৬ জেলায় বিভিন্ন মাত্রায় শ্রমিক সংকট রয়েছে। তবে যথেষ্ট উদ্বৃত্ত শ্রমিক আছে ১৬ জেলায়। আর উচ্চমাত্রার উদ্বৃত্ত শ্রমিক আছে ১৩ জেলায় এবং কিছুটা উদ্বৃত্ত আছে আট জেলায়।
চলতি বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৪ লাখ ৩ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এরই মধ্যে হাওড় অঞ্চলে স্বল্প পরিসরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে পুরোদমে কাটা শুরু হবে। প্রতি বছর এ সময়ে উদ্বৃত্ত শ্রমিকের জেলাগুলো থেকে সংকটে থাকা জেলাগুলোতে গিয়ে ধান কাটার কাজে যোগ দেন মৌসুমি কৃষি শ্রমিকরা। কিন্তু চলমান লকডাউনের কারণে চলতি বোরো মৌসুমে নিজ জেলা থেকে বের হতে পারছেন না এসব শ্রমিক। এ অবস্থায় হাওড় অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে।
ব্রি বলছে, হাওড় অঞ্চলের ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমির ধান কর্তনের জন্য প্রায় ৮৪ লাখ শ্রমিক প্রয়োজন। তবে অঞ্চলটিতে কৃষি শ্রমিকের ১৮ শতাংশ বা প্রায় ১৫ লাখ ১২ হাজার শ্রমিক ঘাটতি রয়েছে। এ এলাকায় ধান কাটতে ২৫ দিনের মতো সময় প্রয়োজন হবে। তাই শ্রমিক ঘাটতি পূরণে দৈনিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমিক এ অঞ্চলে যাওয়া প্রয়োজন। আবার দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বোরো ধান কর্তন মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে জুন অবধি চলবে। লকডাউন অবস্থা এবং সব গণপরিবহন বন্ধ থাকলে শ্রমিক উদ্বৃত্তের অঞ্চল থেকে কৃষি শ্রমিকদের হাওড় অঞ্চলসহ অন্যান্য শ্রমিক সংকট অঞ্চলে যাতায়াত সম্ভব হবে না।
জানা গেছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নরসিংদী, ঝালকাঠি—
এ ছয়টি জেলায় কৃষি শ্রমিকের তীব্র সংকট রয়েছে। এসব জেলায় ২০ শতাংশের কম শ্রমশক্তি কৃষিতে নিয়োজিত। শ্রমিক সংকটের অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি রয়েছে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার। এসব জেলায় শ্রমশক্তির ২১-২৫ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। এছাড়া ফেনী, মুন্সীগঞ্জ, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, খুলনা, বান্দরবান, কুমিল্লা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় কৃষি শ্রমিকের সংকট আছে।
অন্যদিকে শ্রমশক্তি ৩১-৩৫ শতাংশ কৃষি শ্রমিক ভোলা, বগুড়া, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, পাবনা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, মাগুরা, কুষ্টিয়া, নড়াইল, সিরাজগঞ্জ, পঞ্চগড়, খাগড়াছড়ি ও চাঁদপুর জেলায়। ফলে এসব জেলায় কৃষিকাজের জন্য যথেষ্ট উদ্বৃত্ত শ্রমিক পাওয়া যাবে। শ্রমশক্তি ৩৬-৪০ শতাংশ কৃষি শ্রমিক রয়েছে রাজশাহী, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাট, শরীয়তপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর ও নীলফামারী জেলায়। ফলে এসব জেলায় কৃষিকাজে উদ্বৃত্ত শ্রমিক পাওয়া যাবে। ৪১ শতাংশের বেশি শ্রমশক্তি কৃষিকাজে নিয়োজিত রয়েছে ঠাকুরগাঁও, যশোর, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, দিনাজপুর, নওগাঁ, নাটোর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, মেহেরপুর, কুড়িগ্রাম ও সাতক্ষীরা জেলায়। ফলে এসব জেলায় এখন উচ্চমাত্রার উদ্বৃত্ত শ্রমিক পাওয়া যাবে। যদিও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এসব এলাকা থেকে সংকটে থাকা জেলাগুলোয় শ্রমিক যেতে পারছেন না এবার।
শ্রমিক সংকট মেটাতে কৃষিযন্ত্র কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস। তিনি বলেন, একটি ইয়ানমার হারভেস্টার দিয়ে এক হেক্টর ধান কাটতে ১৮ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। কিন্তু এ পরিমাণ ধান কাটতে প্রথাগতভাবে ৬১ জন শ্রমিক লাগবে। একদিনে ইয়ানমার হারভেস্টারের সাহায্যে তিন হেক্টর জমির ধান সর্বোচ্চ ৫৪ জন শ্রমিক দিয়েই কাটানো সম্ভব। কিন্তু প্রথাগতভাবে সেই পরিমাণ জমির ধান কাটতে ন্যূনতম ১৮৩ জন শ্রমিকের প্রয়োজন। পরিস্থিতি অনুসারে আরো বেশি প্রয়োজন হয়। ফলে কম্বাইন হারভেস্টারে ১২৯ জন শ্রমিকের সাশ্রয় করবে। আবার মেনি দিয়ে এখন কাদামাটি ও পড়ে ধাকা ধানও কাটা সম্ভব।
ব্রির তথ্যমতে, এবার হাওড় এলাকায় আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমি। এ অঞ্চলে আগাম বোরো কর্তনের চাপ, কৃষি শ্রমিক সংকট, কর্তনযন্ত্রের ব্যবহার সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ধান কাটা ব্যাহত হতে পারে। অন্যদিকে বাকি এলাকাগুলোয়ও শ্রমিক সংকটসহ নানা কারণে ২ শতাংশ চাল নষ্ট হতে পারে। এক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৩ টন হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে শ্রমিক সংকটে ১৯ লাখ ৪২ হাজার টন চাল নষ্টের আশঙ্কা করছে ব্রি।
এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, এবার ভালো আবাদ হয়েছে। ফলনও খুব ভালো হবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। কিন্তু শ্রমিকের অভাবে ধান কাটতে না পারলে সব উদ্যোগই ব্যর্থ হবে। এজন্য কত দ্রুত সংকটপূর্ণ এলাকায় উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে শ্রমিক নিয়ে যেতে পারছি, তার ওপর নির্ভর করছে সফলতা। পাশাপাশি দ্রুততার ভিত্তিতে সারা দেশে কৃষিযন্ত্র বিশেষ করে কম্বাইন হারভেস্টার ও রিপার মেশিন সরবরাহ করতে হবে। তাছাড়া শ্রমিক চলাচল নিশ্চিত করতে তাদের স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে হবে।
যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে বোরো ধান কাটার শ্রমিকের অভাব থাকা জেলাগুলোতে ধান কাটার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কম্বাইন হারভেস্টার ও রিপার সরবরাহে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান। তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিচালন বাজেটের আওতায় ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে ১০০ কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের কার্যক্রম চলছে। ৬৪টি জেলায় কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার ও রাইস ট্রান্সপ্লান্টার সরবরাহ করা হবে। এছাড়া শ্রমিক চলাচল বাড়াতে বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে উদ্বৃত্ত এলাকায় তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে।