আজ পহেলা বৈশাখ। বাঙালি জাতির ঐতিহ্যগত একটি উৎসবের দিন। এবার দিনটি আগের মত বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে জাঁকজমকপূর্ণভাবে, আনন্দ-উল্লাস করে, হৈ চৈ করে নানান বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে পালন করার সুযোগ নেই। নোভেল করোনা ভাইরাস সে ক্ষেত্রে বাধ সেধেছে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস এবং মুজিব বর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানসহ নানান কর্মসূচি বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে। আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চেও এবার কোন অনুষ্ঠান করা হয়নি। এছাড়া খেলার মাঠ হতে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি, জীবন-জীবিকাসহ সারা বিশ্বে অনেক কিছুই আজ নোভেল করোনা ভাইরাসের ভয়ানক প্রাদুর্ভাবের ফলে স্থবির গেছে। এই ভয়ানক ভাইরাসটি চীনের উহান থেকে আজ অবধি বিশ্বের ২১০ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক দেশে এই ভাইরাসের প্রভাব মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আজ পর্যন্ত বিশ্বে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা যায়। আক্রান্ত হয়েছে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। মাত্র এক মাস আগেও কেউ এরকম পরিণতির কথা চিন্তাও করতে পারেনি। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো আজ এই ভাইরাসের কাছে চরম অসহায় হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইরান, চীন প্রভৃতি দেশে। মৃতের সংখ্যা সবশেষে কত হতে পারে তা নিয়ে অনেকেই অনেক রকম ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। তবে বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় অলৌকিক কিছু না ঘটলে এই ভাইরাসে যে আরও অসংখ্য মানুষের প্রাণ যেতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বর্তমান অবস্থায় বিশ্বের প্রায় সকল দেশই কিভাবে করোনাকে প্রতিরোধ করে নিজ নিজ দেশের জনগণের প্রাণহানি কমানো যায় সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে ও নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
করোনা প্রতিরোধ, করোনার সংক্রমণ, করনার চিকিৎসায় করণীয় বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সময়ে সময়ে বিভিন্ন গাইডলাইন দিচ্ছেন এবং সেই অনুযায়ী প্রতিটি দেশ তাদের নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বের অনেক চিকিৎসক-গবেষকদের মতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করাটা সবচেয়ে জরুরি। এছাড়া ব্যাপক হারে পরীক্ষা করে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা, আইসোলেশন নিশ্চিতকরণ, করোনা আক্রান্ত এলাকা বা করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ধরনের এলাকা লক ডাউন করা, বিদেশ ফেরত বা দেশের মধ্যে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গমনকারীদের জন্য হোম কোয়ারেন্টিন বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার উপর গুরত্বারোপ করা হয়েছে। শুরুর দিকে হোম কোয়ারেন্টিন বিষয়ে অনেকের ধারণা হয়তো পরিষ্কার ছিলো না বা অনেকেই বিষয়টি সঠিকভাবে মেনে চলার ক্ষেত্রে পুরোপুরি গুরুত্ব দেননি। ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পেরেছে যে হোম কোয়ারেন্টিন মানে নিজের বাড়িতে একটি আলাদা রুমে একটানা ১৪ দিন অবস্থান করা। এই সময়ে পরিবারের অন্যদের সংস্পর্শে আসা যাবে না। নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও কাপড়ছোপড় নিজেই পরিষ্কার করে ফেলা ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ সচেতনতা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। প্রত্যেককে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে। একান্ত প্রয়োজনে বাহিরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। নিজেকে সুরক্ষার জন্য অন্যান্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সের, বৃটেনের মত রাষ্ট্রে এতো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও আজ তাদের অবস্থা বড়ই করুণ। আমাদের বাংলাদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ মাদারীপুরের শিবচরে। তিনি ছিলেন ইতালি ফেরত প্রবাসী। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১০১২ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৪৬। আপাতত হিসেবটি খুব বেশি উদ্বেগের না হলেও পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপের দিকেও যেতে পারে। তবে আমাদের সরকার এই ভাইরাস মোকাবিলায় ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এই ভাইরাসটি যেহেতু অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ এবং এটি যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি- কাশির মাধ্যমেই দ্রুত অন্য ব্যক্তির মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে সেহেতু সরকার কর্তৃক যথাসময়ে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে এবং সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সকল জনগণকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে।
এরকম পরিস্থিতিতে জনগণের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে, সামাজিক দুরত্ব ও শারীরিক দুরত্ব নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সহোযোগিতা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে দিনরাত কাজ করতে হচ্ছে। সমগ্র বাংলাদেশে এ লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের নানামুখী কর্মসূচি ও উদ্যোগ ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। একথা সত্য যে, করোনা কিছু শ্রেণির মানুষের জীবনকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করেছে। বিশেষ করে দিনমজুর, নিম্ন আয়ের ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরা অনেক বেশি কষ্টে পড়েছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার এদের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করছে। পাশাপাশি অনেক বিত্তশালীরাও তাদের আশপাশের অসহায় গরীব মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। আশা করি এর মাধ্যমেই এই শ্রেণির মানুষগুলোর কষ্ট কিছুটা লাঘব করা সম্ভব হবে।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, করোনা প্রতিরোধে সাধারণ জনগণ বা নাগরিকরা কী করছেন? গত বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের নানান নির্দেশনা ও আহবানের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের সমন্বয়ে সচেতনতামূলক নানান কর্মসূচি ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে অধিকাংশ মানুষের অসচেতনতার কারণে, আইন ও সরকারি নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধা না থাকায় এসব বিষয়ে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করা কঠিন হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশেও বর্তমানে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে।
আমরা অভিযান পরিচালনাকালে পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে, চায়ের দোকানে, রেল লাইনের উপর, খেলার মাঠে ব্যাপক লোক সমাগম হতে দেখি। এদের অধিকাংশই ঘরে বসে সময় কাটাতে চায় না, সরকারি নির্দেশনা বা আইনগত জটিলতার বিষয়ে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অনেক বয়স্ক মুরব্বিরা জীবনের শেষ সময়ে এসে এসব করোনার ভয়ে আতংকিত নন বলে মনে হয়।
সেদিন এক মুরব্বিকে গ্রামের একটি চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি জানেন না এখন এভাবে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়া, দোকানে চা খাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি যে কোনো মূহুর্তে করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। জবাবে তিনি বললেন, 'আরে বাবা! করোনা কি আমাদের এসব পাড়া-মহল্লা, চিপাচাপায় আইবো। এসব শহরের ব্যাপারস্যাপার। প্লেনে করে আইছে। ঐটা শহরেই থাকবো। আমরা এহানে ভালোই আছি। অসুবিধা নাই।' এই রকম যদি হয় জনগণের ধারণা তাহলে তারা বাসায় থাকার চিন্তা করবে কি? অনেকেই আবার কত বছর, কতদিন পর সাধারণ ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়ি এসেছে। কতদিন সবার সাথে দেখা হয় না। তাই তারা বাড়িতে মেলা জমাচ্ছে, চায়ের দোকানে, পাড়া-মহল্লায় আড্ডা জমাচ্ছে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাজারে ভিড় জমাচ্ছে। তারা কোনোভাবেই বুঝতে চায় না এই ছুটিটি এই জন্য দেওয়া হয়নি। নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করার জন্যই দেওয়া হয়েছে। অন্যদের থেকে দূরে থেকে সামাজিক ও শারীরিক দুরত্ব নিশ্চিত করতেই দেওয়া হয়েছে। অনেক ছেলেপুলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়াতে খেলার মাঠ গরম করায় মেতে উঠেছে। এরা কিংবা এদের অভিভাবকরা বুঝার চেষ্টা করছে না যে এখন এভাবে খেলাধুলা কতটা ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে! আর আমাদের যুবসমাজ এখনো করোনার বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন নন বলে মনে হয়। তারা খামখেয়ালিপনা ভাব দেখিয়ে আইন-নির্দেশনা না মেনেই নিজেদের মতো চলছে। এটি সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। এর পরিণতি অনেক ভয়াবহ হতে পারে!
সামনে রোজা আসছে। সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে এসময় বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে সে লক্ষ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের নিয়মিত মনিটরিং ও অভিযান অব্যাহত থাকবে। সবশেষে করোনা প্রতিরোধে সকল নাগরিকদের প্রতি কিছু সাধারণ পরামর্শ প্রদান করে আমার এই লেখা শেষ করবো।
১. সামাজিক ও শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখুন।
২. জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাহিরে বের হবেন না।
৩. রাস্তা-ঘাটে চলাচল ও কেনাকাটা করার সময় অন্য ব্যক্তি থেকে কমপক্ষে ৩ ফুট দুরত্ব বজায় রাখুন।
৪. আপাতত চায়ের দোকান বা হোটেলের খাবার পরিহার করুন।
৫. হ্যান্ড শেইক ও কোলাকুলি পরিহার করুন।
৬. চায়ের দোকান, খেলার মাঠ, পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে আপাতত আড্ডা-খেলাধুলা একদম বন্ধ রাখুন
৭. গণ পরিবহন ব্যবহার করবেন না। মোটর সাইকেল ও রিকশায় একজনের বেশি চড়বেন না।
৮. গণ জমায়েত ও গণ সমাবেশ এড়িয়ে চলুন।
৯. নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করুন। আপনার বাচ্চাদেরকে কিংবা বাবা-মা, চাচা-চাচী, দাদা-দাদীকে ঘরে থাকতে সর্বোচ্চ সতর্ক করুন।
১০. পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া আপাতত বন্ধ রাখুন।
১১. যে কোন দাওয়াত পরিহার করুন।
১২. নিজের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, জামাকাপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন ও নিজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন।
১৩. বাহির থেকে এসেই কোন কিছু স্পর্শ না করে, কোথাও না বসে হাত ধৌত করে নিবেন সম্ভব হলে গোসল করে নিবেন। পরিষ্কার হওয়ার আগে পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে কমপক্ষে ৩ ফুট দুরত্বে থাকবেন।
১৪. হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু, রুমাল বা হাতের কনুই ব্যবহার করুন।
১৫. বাহির থেকে এসেই আপনার মোবাইল, মানিব্যাগ, সানগ্লাস বা চশমা, চাবি জীবানুমক্ত করে নিন।
১৬. বেশি বেশি হাত ধৌত করুন। বিশেষ করে নাক-মুখ-চোখে হাত দেওয়ার আগে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিবেন।
১৭. বাহিরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
১৮. বেশি বেশি ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাবেন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাবেন। বেশি বেশি পানি পান করবেন।
১৯. অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
২০. আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী গরীব-অসহায়দের সাহায্য করুন।
২১. গুজবে কান দেবেন না ও হুজুগে মেতে উঠবেন না।
২২. সরকারি নির্দেশনা অবশ্যই মেনে চলবেন।
২৩. নিজে সচেতন হবেন এবং অন্যকেও সচেতন করবেন।
লেখক- শরীফ উল্যাহ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।